চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির নিট লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম চার মাসে নিট বিক্রি নেতিবাচক।
সঞ্চয়পত্রে নতুন বিনিয়োগ কমছেই। শুধু তা–ই নয়, আগে কিনে রাখা সঞ্চয়পত্রগুলো বিক্রি করে চলছেন একশ্রেণির মানুষ। কেবল সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে চলে যাচ্ছেন এবং নতুন বিনিয়োগ করছেন না—এমন পরিস্থিতি আগে কখনো দেখা যায়নি। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাই এমন কথা বলছেন।
সঞ্চয় অধিদপ্তর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম চার মাস জুলাই-অক্টোবরের যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে, তাতে একরকম হতাশাজনক চিত্রই উঠে এসেছে। চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রির নিট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম চার মাসে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি নেতিবাচক।
মানুষ ব্যাংক, সঞ্চয় ব্যুরো ও ডাকঘরের মাধ্যমে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে থাকে। সঞ্চয় অধিদপ্তরের চার মাসের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই সময়ে সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ তো হয়ইনি, বরং ৬৩২ কোটি টাকা কম বিনিয়োগ হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, চার মাসে মানুষের কাছ থেকে যত বিনিয়োগ এসেছে, তার চেয়ে বেশি মানুষ সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়েছেন।
তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ এ রকম নেতিবাচক প্রবণতায় খুশি বলে জানা গেছে। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কম হওয়া না–হওয়ার মানে হচ্ছে এই খাত থেকে সরকারকে তেমন ঋণ নিতে হচ্ছে না। সরকার বরং ঋণের জন্য তুলনামূলক সুবিধাজনক বলে বিবেচিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখছে। কারণ, বর্তমানে ব্যাংকঋণ সস্তা।
অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে সরকারকে উচ্চ হারে সুদ গুণতে হয়। এর মানে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেশি হলে সরকারকে সুদও গুণতে হয় বেশি। সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী জুলাই–অক্টোবর ৪ মাসেই সরকারকে সুদ গুণতে হয়েছে ১৫ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলেও জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাকছুদা খাতুন সঞ্চয়পত্রের কোনো বিষয় নিয়েই কথা বলতে রাজি হননি।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২ অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় দেশজ সঞ্চয় কমে আসছে। অর্থাৎ জিডিপি যে হারে বাড়ছে, সঞ্চয় সেভাবে বাড়ছে না। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপির তুলনায় দেশজ সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল ২৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে কমে হয়েছে ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এ ছাড়া ব্যাংকে আমানত রেখে যে সুদ মিলছে, তা দিয়ে মূল্যস্ফীতির ঘাটতি পূরণ হচ্ছে না।
বিনিয়োগ কমার কারণ
দেশে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র আছে। এগুলোর গড় সুদ একসময় ১১ শতাংশের বেশি ছিল। গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রজ্ঞাপন জারি করে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমিয়েছে সরকার। একই প্রজ্ঞাপনে কয়েকটি স্তর করে দিয়েছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি)। এর পর থেকেই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কম হচ্ছে বলে সঞ্চয় অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মনে করছেন।
বিনিয়োগ কমার আরও কারণ রয়েছে। যেমন পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে প্রত্যেক গ্রাহককে বাধ্যতামূলকভাবে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হয়। সঞ্চয়পত্র ও ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক হিসাবে পাঁচ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার ব্যাংক হিসাবে জমা টাকা ১০ লাখ অতিক্রম করলেও দিতে হয় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র।
আলেয়া বেগম নামের একজন বিনিয়োগকারী বলেন, সংসারের মাসিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ভাঙতে হয়েছে। নতুন বিনিয়োগের উপায় নেই বলেও জানান তিনি।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি দল এক মাস আগে বাংলাদেশ সফরকালে অর্থ বিভাগের সঙ্গে এক বৈঠকে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাজারদরের কাছাকাছি রাখার সুপারিশ করে। অর্থ বিভাগ আইএমএফকে জানায়, আইএমএফের এ সুপারিশ মেনে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার সরকার আরেক দফা কমাতে পারে। এটিও মানুষকে সঞ্চয়পত্রবিমুখ করে তুলতে পারে।
চার মাসের চিত্র
গত অক্টোবর মাসে সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে মোট জমা পড়ে ৬ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা। আর মূল পরিশোধ হয় ৭ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। মোট জমা থেকে মূল পরিশোধ বাদ দিয়ে নিট বিনিয়োগ বের করতে হয়। কিন্তু অক্টোবর মাসে মোট জমা থেকে মূল পরিশোধ বেশি হয়েছে ৯৬৩ কোটি টাকা। ব্যাংক, সঞ্চয় ব্যুরো ও ডাকঘরের মধ্যে শুধু ব্যাংকের মাধ্যমে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রে নিট বিনিয়োগ আছে ১ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। বাকি দুই মাধ্যমেই তা নেতিবাচক।
বিনিয়োগের আকর্ষণীয় এক কর্মসূচি ‘পরিবার সঞ্চয়পত্র’
একইভাবে অক্টোবরসহ ৪ মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ব্যাংক, সঞ্চয় ব্যুরো ও ডাকঘরে মোট জমা পড়েছে ২৮ হাজার ৪৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে মূল পরিশোধ দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। মোট জমার তুলনায় মূল পরিশোধ ৬৩২ কোটি টাকা বেশি। চার মাসের মধ্যে ব্যাংক ও সঞ্চয় ব্যুরোর মাধ্যমে বিক্রির পর নিট বিক্রি আছে। কিন্তু ডাকঘরের মাধ্যমে বিক্রিতে এত বেশি মূল পরিশোধ হয়েছে যে সব মিলিয়ে নিট বিক্রি আর ইতিবাচক হয়নি।
২০২১-২২ অর্থবছরে নিট বিক্রি ছিল ১৯ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা, যা চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে না বলে আশঙ্কা সঞ্চয় অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি প্রথম আলোকে বলেন, দেশের অর্থনীতিতে খারাপ পরিস্থিতি চলছে। নিম্নবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তকেও বিপাকে ফেলেছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য নেই। কেউ যখন ব্যয় কমিয়েও চলতে পারছেন না, তখনই সঞ্চয়ে হাত দিচ্ছেন। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের নেতিবাচক চিত্র মূলত মানুষের সংকটে থাকার বহিঃপ্রকাশ।