কোয়ার্টার ফাইনালে ধরাশায়ী হলো ব্রাজিল। টাইব্রেকারে ক্রোয়েশিয়ার কাছে ৪-২ গোলে হেরে বিদায় নিল। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্রাজিলভক্তদের বিশ্বকাপও বলতে গেলে শেষ হয়ে গেছে। তবে আশা জাগিয়ে রেখেছে আর্জেন্টিনা। তারা একইভাবে কোয়ার্টার ফাইনালে টাইব্রেকারে নেদারল্যান্ডকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠে গেছে। ব্রাজিল হেরে গেলেও সারা দেশে বিশ্বকাপ জোয়ারের এখনো শেষ হয়নি। কেউ কেউ এরই মধ্যে ফ্রান্সের পক্ষ নিয়ে ফেলেছেন। আফ্রিকান-আরব দেশ মরক্কো পর্তুগালকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠায় এই দেশটির সমর্থকেরও দেখা মিলছে বাংলাদেশে।
প্রতি চার বছর পর বিশ্বব্যাপী ফুটবলের আসর বসে। বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই খেলাপাগল। সারা দেশে এক ধরনের উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। মাঠে-ময়দানে, চা-দোকান থেকে হাটবাজার, বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, সব জায়গাই ফুটবলের হাওয়া। রাতদিন চলে চুলচেড়া বিশ্লেষণ আর জয়-পরাজয়ের হিসাবনিকাশ। ১৯৩০ সালে প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল উরুগুয়েতে আয়োজিত হলেও বাঙালিদের সঙ্গে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রকৃত সখ্য গড়ে ওঠে আরো পরে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনায় আয়োজিত বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচ সম্প্রচার করার কারণে বাংলাদেশের প্রান্তিক এলাকায়ও বিশ্ব ফুটবলের বিষয়গুলো আলোচনায় আসে। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের সব ম্যাচ সম্প্রচার করার মধ্য দিয়ে বাঙালিদের অস্থিমজ্জায় ঢুকে পড়ে বিশ্বকাপ ফুটবল।
সারা দেশের মানুষ যখন ফুটবলের উৎসবে নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছে, সেখানে আমাদের ফুটবলের অবস্থান কোথায়, সে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই সামনে আসে। দেশের মানুষের ফুটবলের প্রতি এত দরদ, উন্মাদনা থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব ফুটবলে আমরা কেন তলানিতে, সে প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়। মাত্র ৩ লাখ মানুষের দেশ আইসল্যান্ড বর্তমানে ইউরোপের উঠতি ফুটবল শক্তি হলেও প্রায় ১৭ কোটির দেশে ফুটবলের কেন দৈন্যদশা সে প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক। আমরা ফুটবল আমদানিতে ৫৪তম, অথচ র্যাংকিংয়ে তলানিতে, ১৯২তম। কারণ বাংলাদেশের ফুটবলে সাংগঠনিক দক্ষতার অভাব বেশ পরিলক্ষিত। রয়েছে উদ্যোক্তা ও উদ্যোগেরও অভাব।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতা শুরু হয় ২০১১ সালে। যেখানে প্রতি বছর ৬৪ হাজার স্কুলের প্রায় ১০ লাখের ওপরে মেয়ে ফুটবলার অংশ নিচ্ছে। যা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে, দেশের সুনাম বয়ে আনছে। জাতীয় স্কুল ফুটবলও জাতীয় ফুটবলার তৈরিতে রাখছে অবদান। স্কুল ও বয়সভিত্তিক ফুটবল নিয়ে আরো ব্যাপক পরিসরে পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। জেলা লিগকে আরো উজ্জীবিত করতে হবে।
এ কথা ঠিক যে, ঢাকা শহরে যথেষ্ট মাঠ নেই অনুশীলনের জন্য, ঢাকার আশপাশের এলাকায় মাঠ তৈরি করতে হবে। ক্লাবগুলোকে প্রয়োজনে ঢাকার আশপাশে স্থানান্তর করা যেতে পারে। যাতে পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্লাবগুলো খেলোয়াড় তৈরিতে অবদান রাখতে পারে। সর্বোপরি ক্লাবগুলোকে পেশাদারিত্ব মনোভাব পোষণ করতে হবে। শুধু সরকারের ওপর নির্ভর না করে নিজেদেরও পরিকল্পনা থাকতে হবে। নিজস্ব মাঠ সবসময় থাকতে হবে। দেশে বিদ্যমান মাঠগুলোকে খেলার উপযোগী করতে হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া, যিনি ডেনমার্কের সবচেয়ে বড় ক্লাবের হয়ে খেলতেন। কিন্তু দেশের টানে এসে ২০১৩ সালে জাতীয় ফুটবল দলের সদস্য হয়ে খেলছেন নিয়মিত। ফিনল্যান্ডের লিগে খেলা তারেক রায়হান কাজী বাংলাদেশ জাতীয় দলে একজন পরীক্ষিত ডিফেন্ডার। পোল্যান্ড প্রবাসী ফরিদ আলী, যিনি খেলছেন পোল্যাল্ডের সেকেন্ড ডিভিশনে। যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসের স্পোর্টিং ইউনাইটেড সকার ক্লাবের হয়ে খেলছেন জিদান মিয়া। লেইচেস্টার সিটির মিডফিল্ডার হামজা চৌধুরী, ইংল্যান্ড প্রবাসী এই ফুটবলার ভবিষ্যতে ইংল্যান্ড জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার অপেক্ষায়। কানাডিয়ান বাংলাদেশি সামিত বোস। এভাবেই হয়তো আরো অনেকের নামই পাওয়া যাবে, যারা বিভিন্ন দেশের ফুটবলে রাখছেন অবদান। বাফুফে তাদের খবরাখবর নিতে পারে, বাংলাদেশের ফুটবলে এসব তারকা ফুটবলার আনার উদ্যোগ নিতে পারে। দেশের ফুটবলের উন্নয়নে প্রবাসীদের আগ্রহ বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে পারে বাফুফে।
এক সময় আমাদের পাড়া-মহল্লায় আবাহনী কিংবা মোহামেডানের পতাকা টানানোর হিড়িক পড়ত। যথাযথ উদ্যোগ নিলে ফুটবলের সুদিন আমরা আবার ফিরে পেতে পারি।