বিশ্বকাপ ফুটবল উত্তাপে পুড়ছে বিশ্ব। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাভাব, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি পাশ কাটিয়ে ফুটবলজ্বরে কাঁপছে সারা বিশ্ব। আরব সাগর পাড়ি দিয়ে কাতার বিশ্বকাপের উন্মাদনা হাজির হয়েছে বঙ্গদেশের অলিগলি, পাড়া-মহল্লায়। আমাদের নায়েমের গলির চায়ের দোকান থেকে শুরু করে টিএসসির বড় পর্দা—সবখানেই আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল। রাত জাগা পাগলামিতে হাজির হয়েছেন দলে দলে। আনন্দ-বিষাদের এই বৈশ্বিক আয়োজনে আবেগপ্রবণ বাঙালি শরিক হয়েছেন সরব উপস্থিতি নিয়ে।
আবেগের এই অতি উত্তাপ সময়ে সময়ে বিষাদে পরিণত হচ্ছে। আর্জেন্টিনার পতাকা ওড়াতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন খাগড়াছড়ির দীপেন ত্রিপুরা ও সফিপুরের তানভীর হাসান। বাঙালির এই জীবন বাজি রাখা আবেগ নিয়ে ‘দি ওয়াশিংটন পোস্ট’ ‘In Bangladesh, the Argentina-Brazil soccer rivalry is a curious ‘frenzy’ শিরোনামে প্রতিবেদন লিখেছেন বিখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক চাক কাল্পেপার। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ব্রাজিল-সমর্থক রেজাউলের চাচা নওয়াব মিয়ার নাক ফাটিয়েছে আর্জেন্টিনার সমর্থক জীবন মিয়া ও তার দল। আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম ‘বুয়েন্স এইরেস টাইমস’—এই খ্যাপাটে মনোভাব নিয়ে আক্ষেপ করে প্রতিবেদন ছাপিয়েছে।
ফুটবলপ্রেমীদের কাছে বিশ্বকাপ পাগল করা বিনোদন হলেও আয়োজনকারীদের কাছে বিশাল ব্যবসার সম্ভাবনা, ভূরাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যম। আমাদের কাছে মেসি নান্দনিক শিল্পের স্রষ্টা হলেও স্প্যানিশ অর্থনীতিতে তিনি জিডিপির খাত। লা লিগার সভাপতি হাভিয়ের তেবাসের দেওয়া তথ্য মতে স্পেনের মোট দেশজ উৎপাদনে মেসিদের প্রভাব প্রায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ। স্পেনে মেসির উপস্থিতিতে তৈরি করেছিল অতিরিক্ত প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ। সংবাদ মাধ্যম প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন মোতাবেক বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য স্টেডিয়াম, যাতায়াত, অবকাঠামো, নিরাপত্তা ইত্যাদি খাতে কাতার বিনিয়োগ করেছে প্রায় ৪ হাজার ২২৯ বিলিয়ন ডলার। যেখানে ২০১৮ এবং ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনে রাশিয়া ও ব্রাজিলের বিনিয়োগ ছিল যথাক্রমে মাত্র ১৬ বিলিয়ন ও ১৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।
কাতার এমন একসময়ে হাত খুলে খরচ করছে যখন বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি ছুটে চলছে পাগলা ঘোড়া হয়ে, বৈশ্বিক মহামন্দা চোখ রাঙাচ্ছে কটমট করে। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশের জনজীবনেও হাজির হয়েছে ডলারের সংকট, মূল্যস্ফীতির প্রভাব। টান পড়েছে আমদানি, রপ্তানি খাতে। ব্যয় সংকোচনে বহুমুখী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে দূরদর্শী সরকার। আর এমন সময়ে আমাদের আবেগপ্রবণ ফুটবলপ্রেমীরা হাজার মাইল দূরের দেশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার হয়ে গলা ভাঙছে, অন্যের মাথা ফাটাচ্ছে। এসব দেখে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল সম্পর্কে আমাদের জানার আগ্রহ বাড়ে। জানতে ইচ্ছে করে, দেশ দুইটির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্র ও পরিধি। যদিও অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের পূর্ণমাত্রা জানা এবং অল্প পরিসরে আলোকপাত করা শুধু দুরূহই নয়, প্রায় অসম্ভব। তথাপি আমরা মোটা দাগে, নিরপেক্ষ দর্শকের মতো দেখতে চাইব ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা এবং কাতারের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক রসায়ন। উল্লেখিত চারটি দেশের মধ্যে কাতার এগিয়ে আছে মূলত তাদের উচ্চ মাথাপিছু জিডিপির কারণে। লোকসংখ্যা কম তাই মাথাপিছু জিডিপির হিস্যা বাকি তিনটি দেশ থেকে যোজন উচ্চতায় অবস্থান করছে।
বাংলাদেশকে এখনো অন্য তিনটি দেশের সঙ্গে তুলনা করা যায় না; কিন্তু বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বগুণে রপ্তানি আয়েও এগোচ্ছে, উন্মোচিত হচ্ছে নতুন দিগন্ত। প্রথম বারের মতো অতিক্রম করেছে ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক। গার্মেন্টস আধিক্য বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের মূল প্রবাহ ইউরোপ ও আমেরিকায়। তুলনায় আর্জেন্টিনায় বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার খুবই ছোট। বিগত অর্থবছরে আর্জেন্টিনাতে রপ্তানি করা হয়েছে মাত্র ৯ দশমিক ৫১৮ মিলিয়ন ডলারের নিটওয়্যার, ওভেন গার্মেন্টস, খেলনা ইত্যাদি পণ্য। আর্জেন্টিনার তুলনায় ব্রাজিলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার প্রায় ১১ দশমিক ৪৭ গুণ বড়। বিগত অর্থবছর ব্রাজিলে ১০৯ দশমিক ২০২ মিলিয়ন ডলারের গার্মেন্টস, তামাক, প্ল্যাস্টিক ও রাবাবের পণ্য, কারুপণ্য, খেলার জার্সি, ওষুধ, মেডিক্যাল যন্ত্রাংশ, স্টিলের গাড়ির যন্ত্রাংশ ইত্যাদি পণ্য রপ্তানি করা গেছে। গত বছর বাংলাদেশ থেকে কাতারে ৪২ দশমিক ২৯৮ মিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন গার্মেন্টস পণ্য ও আলু, পটোল, চাল, টম্যাটো ইত্যাদি বিক্রি হয়েছে।
রপ্তানি আয় বাড়লেও অব্যাহতভাবে বেড়ে চলছে আমদানি ব্যয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫২ হাজার ৮২ দশমিক ৬৫৮ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের বিপরীতে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৭৫ হাজার ৬০৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত Annual Import Payments of Goods and Services 2021-2022 মোতাবেক ২০টি শীর্ষ আমদানিকারক দেশের মধ্যে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল ও কাতার অন্যতম। ২০২১-২২ অর্থবছর নামমাত্র ৯ দশমিক ৫১৮ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানির বিপরীতে আর্জেন্টিনা থেকে আমদানি করা হয়েছে ৭৯১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলারের ভৈজ্য তেল, দানাদার জাতীয় খাদ্যশস্য। বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৭৮২ মিলিয়ন ডলার। আমদানিকারক দেশের মধ্যে ব্রাজিলের অবস্থান অষ্টম, কাতার আছে নবম স্থানে। ব্রাজিলের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যঘাটতি প্রায় ২ হাজার ১৩৬ মিলিয়ন ডলার। গত বছর ব্রাজিল থেকে ২ হাজার ২৪৫ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলারের খাদ্য পণ্য যেমন—তেলবীজ, দানাদার শস্য ও চিনি, তুলা, কফি, তামাক জাতীয় পণ্য ইত্যাদি আমদানি করা হয়েছে ব্রাজিল থেকে। বাংলাদেশ তার মোট আমদানির ২ দশমিক ৯ শতাংশ করে থাকে কাতার থেকে এবং কাতারের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যঘাটতি প্রায় ২ হাজার ১৩৫ মিলিয়ন ডলার।
মুক্তবাণিজ্য অর্থনীতির যুগে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের সঙ্গে সব দেশের বাণিজ্য পরোক্ষ অথবা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। পক্ষান্তরে অর্থনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপ্তি নির্ভর করে দুইটি দেশের আর্থিক সংগতি ও রাজনৈতিক সম্পর্কের ওপর। আলোচ্য তিনটি দেশের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্কের পরিধি কতটা বিস্তৃত—এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের আলোকপাত করতে হবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত ‘Flow of External Resources into Bangladesh 2020-2021, Golden Jubilee Special Edition’ মোতাবেক স্বাধীনতার পর থেকে ৩০ জুন ২০২১ পর্যন্ত সময়ে মোট প্রায় ১০১ দশমিক ৩ হাজার ৬৭৩ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ সহায়তা হিসেবে পাওয়া গেছে। যার মধ্যে ২৮ দশমিক ৫১৯ বিলিয়ন ডলার এসেছে অনুদান হিসেবে এবং ৭২ দশমিক ৮ হাজার ৪৮৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ। আমাদের আকাশে বাতাসে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের পতাকা পতপত করে উড়লেও তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগিতামূলক অর্থনৈতিক সম্পর্ক শূন্যের কোটায়। তিনটি দেশের করো সঙ্গেই বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক ঋণ-অনুদান আকারে প্রকল্প/খাদ্য-পণ্য সহায়তা সম্পর্কিত কোনো আনুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেশ তিনটিকে দেখা হচ্ছে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় উন্নয়ন সহযোগী দেশ হিসেবে।
উন্নয়ন সহযোগিতা সম্পর্কিত কোনো সম্পর্ক না থাকলেও রেমিট্যান্স প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আলোচ্য তিনটি দেশের মধ্যে কাতারের অবদান অগ্রগণ্য। বেশি আমদানি ব্যয়ের বিপরীতে কম মাত্রার রপ্তানি আয়ের ফলে সৃষ্ট বাণিজ্যঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া হয় রেমিট্যান্সের মাধ্যমে প্রাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে। রেমিট্যান্সের কল্যাণে অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে অগ্রযাত্রায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে আগত ২১ হাজার ৩১ দশমিক ৬৮ মিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স মধ্যে কাতার থেকে এসেছে মোট ১ হাজার ৩৪৬ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন ডলার, যা মোট প্রাপ্ত রেমিট্যান্সের ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত ‘Migration and Development Brief 37’ শীর্ষক প্রতিবেদন মোতাবেক ২০২১ সালে বাংলাদেশ ছিল সপ্তম রেমিট্যান্স অর্জনকারী দেশ এবং বাংলাদেশে পাঠানো দেশের মধ্যে কাতারের অবস্থান ষষ্ঠ। এ সময়ে ব্রাজিল আর্জেন্টিনা থেকেও যৎসামান্য রেমিট্যান্স এসেছে বাংলাদেশে।
খেলার মাঠে যা-ই হোক, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তারা সবাই আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন লালিত ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ পররাষ্ট্রনীতির কল্যাণে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কাতার—সবাই আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। আর্জেন্টিনার লেখক-সম্পাদক বিদুষী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর উদ্যোগে আর্জেন্টিনার বুদ্ধিজীবীরা ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষাবলম্বন করে বিবৃতি দিয়েছিলেন, গণহত্যার বিরুদ্ধে নানা রকমের প্রতিবাদ সংগঠিত করেছিলেন। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে ব্রাজিল-বাংলাদেশ একে অপরকে প্রত্যক্ষ ভোট দিয়ে সমর্থন দেওয়ার একাধিক উদাহরণ আছে। কাতার তুলনামূলক ছোট অর্থনীতির দেশ হলেও আমাদেরকে জ্বালানি তেল ও সারের মতো অতীব জরুরি উপকরণ আমদানি করতে হয় কাতার থেকে। অর্থনীতির অগ্রযাত্রা সচল রাখতে কাতার থেকে আগত রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে এই কঠিন সময়ে।
অর্থনীতির কঠিন সময়ে মহামন্দার আশঙ্কায় পুরো বিশ্ব। করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত বৈশ্বিক অর্থনীতির সংকটকালে নতুন উপদ্রব হিসেব হাজির হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব আর সাহসী পদক্ষেপে ভর করে বাংলাদেশ সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবিলা করছে বর্তমান সংকট। এমন বৈরী সময়ে হাজার মাইল দূরের দুইটি দেশের খেলা দেখাকে কেন্দ্র করে খুনশুটি চলতে পারে, কারো নাক ফাটিয়ে নিজেদের কান কাটার কোনো মানে হয় না। খেলাধুলা হোক নিরেট বিনোদনের উপলক্ষ্য। অহেতুক ব্যক্তিগত বৈরিতা পরিহার করে শৈল্পিক ফুটবল উপভোগ করাই হোক খেলা দেখার একমাত্র উদ্দেশ্য।