বেত্রাঘাত। বেতের ছড়ি দিয়ে আঘাত। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাস্যকৌতুক ‘ছাত্রের পরীক্ষায়’ কালাচাঁদের বেত্র আস্ফাালন পর্বে লিখেছেন—
কী মশায়, মারেন কেন? আমি কি মিথ্যে কথা বলছি?
অভিভাবক। আচ্ছা, সিরাজদ্দৌলাকে কে কেটেছে? ইতিহাস কী বলে?
মধুসূদন। পোকায়।
‘বেত্রাঘাত’
আজ্ঞে মিছিমিছি মার খেয়ে মরছি—শুধু সিরাজদ্দৌলা কেন, সমস্ত ইতিহাসখানাই পোকায় কেটেছে! এই দেখুন।
এভাবেই বেতের কাছে ফেঁসে আছে জ্ঞানশ্রেষ্ঠ বাঙালি ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকেরা।
এইতো সেদিনের আগে যখন বেত ও জ্ঞানের এক আশ্চর্য যুগলবন্দির জন্য শিক্ষকদের এলাকার মানুষ একাধারে ভয়, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসত। ছাত্ররা চলতি পথে শিক্ষাগুরুকে অদ্বিষ্ট দৃষ্টিগোচর হতেই রাস্তা বদলে অন্য রাস্তা ধরেছে। শিক্ষকের মার খায়নি এরকম ছাত্র খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ছিল। হয় পড়া না পারা, নচেত দুষ্টামি বা শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে দোষী। কত বেত যে ভেঙে গেছে ছাত্রদের পশ্চাতে। কান ধরা, বকা, এক পায়ে দাঁড়ানো, কান ধরে বেঞ্চের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা—এসব তো ছিল আনন্দের শাস্তি। স্কুল ছুটিতে বাড়ি ফেরার পর ছাত্রের মা ক্ষতস্থান অক্ষিগত হলে বলত, এভাবেই মানুষ হয়ে উঠতে হবে। এইতো ছিল আমাদের গুরু-শিষ্যপরম্পরা। ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকের সম্পর্ক। শাসনের মধ্যে থেকে সুগঠিত হয়েছে কয়েক প্রজন্ম।
যুগ পালটেছে। এক প্রজন্মের সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মের একটা তারতম্য থাকাটা স্বাভাবিক। শিক্ষক-ছাত্রের যে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক ছিল, তা পালটে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠা সময়ের ন্যায্যতা। এখনকার ছাত্ররা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্মার্ট ছাত্র। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব তথা ডিজিটাল শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় প্রস্তুত হচ্ছে আমাদের নবপ্রজন্ম। আমরা চাই বা না চাই, এত দিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম, চিন্তা-চেতনা যেভাবে চলেছিল সেটা বদলে গেছে। আমাদের সন্তানেরা হয়ে উঠেছে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও আবেগপ্রবণ। ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়ে আমাদের সন্তানদের ওপর শিক্ষক কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনের চিত্র আমরা সংবাদপত্র মারফত জানতে পেরেছি। খবরের কাগজে শারীরিক নির্যাতনের নির্মম পরিণতির চিত্রও প্রকাশিত হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থার রিটে আদালত গড়িয়ে ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি রহিত করা সংক্রান্ত নীতিমালা-২০১১’ জারি হলো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি শিশুদের জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করে এবং তা নিষ্ঠুর, অমানবিক, অপমানকর আচরণ মর্মে উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল। এ কথা অনস্বীকার্য যে, শারীরিক শাস্তি ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধির পথে অন্তরায়। এটা শিক্ষার্থীদের স্কুলের প্রতি অনাগ্রহী করে তোলে, যা অশিক্ষা ও দারিদ্র্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমি চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রায় ৩ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত একটি স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের শিক্ষানুরাগী সদস্য। শারীরিক শাস্তি বন্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক যে পরিপত্রটি জারি রয়েছে, আমি তার প্রতি সমর্থন জানাচ্ছি। আমি মনে করি, শারীরিক শাস্তি শিক্ষার্থীর আবেগকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। যখন সে নিশ্চিত হবে যে স্কুলে গেলে শারীরিক শাস্তি ভোগ করতে হবে, তখন সে স্কুলে যেতে চাইবে না। শিক্ষার্থী যখন স্কুলে আসবে না, তখন কোনো কাজে আসবে না শিক্ষাক্ষেত্রে সামগ্রিক উন্নয়ন।
কিন্তু ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে, সেই আইনের সুযোগে কিছু কিছু শিক্ষার্থী বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তারা বিদ্যালয়ের ব্যাগে অতিরিক্ত পোশাক নিয়ে আসে, যাতে করে সিভিল পোশাকে পার্কে বা অন্যত্র স্বাচ্ছন্ধ্যে ঘুরে বেড়াতে পারে। নিজের গায়ে নিজেই ব্লেড দিয়ে ক্ষত সৃষ্টি করে জাতীয় জরুরি সেবার নম্বরে ফোন দিয়ে শিক্ষকের জন্য পুলিশ নিয়ে আসে। ছাত্রদের ব্যাগে পাওয়া যাচ্ছে ছুরি, ইলেকট্রিক মাদকের ডিভাইসসহ নানা নিষিদ্ধ বস্তু। এসব বিচিত্র ও ব্যতিক্রমী ধরনের সমস্যা দেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এই সমস্যার সমাধানে সব মহলের আন্তরিকতা প্রয়োজন। সমস্যার সমাধানে পরিবারের ভূমিকাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিতভাবে ‘অভিভাবক সমাবেশের’ আয়োজন করে অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে। ‘শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে’ নীতিতে আমাদের সন্তানদের বিপথে যাওয়া ঠেকাতে সবাইকে সহযোগী হতে হবে। শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের বিকল্প সমাধান নিয়ে ভাবতে হবে। ভালো কাজের স্বীকৃতি দিয়ে ইতিবাচক শৃঙ্খলার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্কোন্নয়নে শিক্ষকদের ব্যবহারেও পরিবর্তন আনতে হবে।
রাষ্ট্র বেত্রাঘাতকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেত্রাঘাতে ‘শূন্য সহনশীলতা’ প্রদর্শন করা হচ্ছে। শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের অন্যায় আচরণকে উপেক্ষা করার কৌশল অবলম্বন করে শাস্তি দেওয়ার অন্যতম হাতিয়ার ‘বেত’কে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই উদ্যেগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
কিন্তু স্কুলগেটের বাইরে অবস্থিত বইয়ের দোকানগুলোতে প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে সেই ‘বেত’। অভিভাবকেরাই এই বেতের ক্রেতা। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, স্বকীয় প্রক্রিয়ায় বেতের ব্যবহার কি আইনসিদ্ধ!