রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলার প্রক্রিয়া ডলার সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে। শুরুতে ৫২ কোটি ৪২ লাখ ডলারের (প্রায় ৫ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা) এলসি দেশের কোনো ব্যাংক খুলতে রাজি ছিল না। সম্প্রতি এলসি বিষয়ে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) বিদ্যুৎ বিভাগের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়। এ পটভূমিতে অর্থ মন্ত্রণালয় সংশ্নিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খোলার সিদ্ধান্ত নেয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলারের নিশ্চয়তার শর্তে সোনালী ব্যাংক এলসি খুলতে রাজি হলেও বিষয়টি প্রায় এক মাস ঝুলে আছে। ফলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে দেখা দিয়েছে জটিলতা।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও পিজিসিবি সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর কেন্দ্রের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে সঞ্চালন লাইন তৈরির প্রকল্পটি ২০১৮ সালে একনেকে অনুমোদন পেয়েছিল। প্রকল্পের আওতায় সাতটি প্যাকেজের কাজ চলছে। এর মধ্যে যমুনা নদীতে সাত কিলোমিটারের একটি ৪০০ কেভি লাইন, সমদৈর্ঘ্যের আরেকটি ২৩০ কেভি লাইন এবং পদ্মা নদীতে দুই কিলোমিটারের একটি ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হবে। এ কাজ দ্রুত এগিয়ে নিতে ভারতীয় এলওসির অর্থায়ন থেকে বেরিয়ে নিজস্ব টাকায় কাজ শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয় পিজিসিবি। তবে ডলার সংকটে এখন পর্যন্ত কাজই শুরু করা যায়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পিজিসিবির নির্বাহী পরিচালক মো. ইয়াকুব ইলাহী চৌধুরী বলেন, বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁরা বিদ্যুৎ বিভাগের মাধ্যমে ঋণপত্র খোলার প্রস্তাব সোনালী ব্যাংকে পাঠিয়েছেন। তবে এখনও এলসি খোলা হয়নি। কেন দেরি হচ্ছে, সেটা সোনালী ব্যাংকই বলতে পারবে।
জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আফজাল করিম বলেন, এলসি খোলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। ব্যাংকটির ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ডিএমডি) সুভাষ চন্দ্র দাস বলেন, এলসি খোলার জন্য আমরা পিজিসিবি থেকে প্রস্তাব পেয়েছি। আমরা বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষ করে এনেছি। খুব শিগগির বাকি কাজ শেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো হবে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে ডলারের সংকট থাকলেও একেবারে নেই- এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। রেমিট্যান্স আসছে, রপ্তানি আয় আসছে। তারপরও কোনো ব্যাংকের যদি সমস্যা হয় তবে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনে সহায়তা দেবে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন স্থাপনে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানি সংক্রান্ত ঋণপত্র খোলার প্রস্তাবটি এখনও সোনালী ব্যাংক থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আসেনি। এলে সে অনুযায়ী আমরা সিদ্ধান্ত নেব।
এদিকে পাবনায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের শেষ নাগাদ উৎপাদনক্ষম হয়ে উঠবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট। এটি উৎপাদনে সক্ষম হলেও সময়মতো সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত না হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বসিয়েই রাখতে হবে। যদিও এর ক্যাপাসিটি চার্জ, ঋণের অর্থ, সুদ পরিশোধসহ অন্য খরচ ঠিকই বহন করতে হবে সরকারকে। তবে সঞ্চালন লাইনের ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ নদী পারাপারের কাজটি বাস্তবায়নে এলসি খুলতে না পারায় ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের আগে সেই বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ভারতের ঋণে সঞ্চালন লাইন হওয়ার কথা ছিল। তবে ভারত ঋণে যে সুদহার নির্ধারণ করেছিল, সেটা অনেক বেশি। তাই বাংলাদেশ সরকার ভারতের ঋণ না নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। সরকার যখন নিজস্ব অর্থায়নে সঞ্চালন করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন ডলার সংকট ছিল না। এখন ডলার সংকট প্রকট হওয়ায় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, তীব্র ডলার সংকটের মধ্যে সরকার এখন কী সিদ্ধান্ত নেবে, জানি না। তবে কোনো একটা উপায় বের করতে হবে। শুধু রূপপুর নয়; বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত হলেও সঞ্চালন লাইন না হওয়ায় সেগুলো অলস পড়ে আছে। এতে দেশ আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে। এসব প্রকল্প হাতে নেওয়ার সময় অর্থায়নের বিষয়টি পরিকল্পিতভাবে নেওয়া হয়নি। তাই এ সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। দেশের বর্তমান অর্থনীতির নাজুক পরিস্থিতির জন্য পরিকল্পনার অভাবকে দায়ী করেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, যে পরিস্থিতিই হোক না কেন; সরকারকে রূপপুরের সঞ্চালন লাইন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পকে বসিয়ে রাখা ঠিক হবে না।
শুধু নদী পারাপারের প্যাকেজ নয়, সার্বিকভাবে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ প্রকল্পটিরই বাস্তবায়নের গতি সন্তোষজনক নয় বলে জানা গেছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ লাইন নির্মাণে অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৪৫ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালের এপ্রিলে। যদিও এর কাজ শুরু হয় তিন বছর পর। ১০ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা খরচায় সাতটি প্যাকেজে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা।
ধীর গতি বিষয়ে পিজিসিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন. প্রকল্প অনুমোদন, অর্থায়ন ও জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দেরি হওয়ার কারণে কাজ পিছিয়ে পড়েছে। বিশেষ করে করোনার কারণে প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল প্রায় দেড় বছর। তবে বর্তমানে এসব কাজে গতি ফিরেছে। তাঁরা সময়মতো কাজ শেষ করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রসঙ্গত, কয়েক মাস ধরে ডলার সংকটের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছেই। গত ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৩ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। অথচ গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। রিজার্ভ কমে আসায় তৈরি হওয়া সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিচ্ছে সরকার। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক এবং জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা থেকেও ঋণ নেওয়ার চেষ্টা চলছে।