বুধবার বিকাল পাঁচটা। রাজধানীর কাওরান বাজারের ওয়াসা ভবনের সামনের সড়কে আটকা একটি এম্বুলেন্স। রোগীর মাথার উপর ঘুরছে ছোট একটি ফ্যান। তীব্র গরমে ঘেমে একাকার রোগী। রোগীকে স্বস্তি দিতে বাতাস করে যাচ্ছেন স্বজনরা। কিন্তু এম্বুলেন্স যে নড়ছেই না।
এম্বুলেন্স চালক মো. ফিরোজ বলেন, ফার্মগেট থেকে কাওরানবাজারে আসতে সময় লাগছে এক ঘণ্টা ১০ মিনিট। অপারেশনের রোগী নিয়ে যাবো মুন্সীগঞ্জ। আর পঙ্গু হাসপাতাল থেকে এই পর্যন্ত আসছি দেড় ঘণ্টায়। অনেকক্ষণ সাইরেন বাজাইছি কোনো লাভ হয় নাই। তাই এখন চুপ করে বসে আছি।
এম্বুলেন্সের ভিতরে থাকা রোগীর ভাই আসিফ বলেন, একটু আগে এম্বুলেন্স থেকে নেমে ট্রাফিক পুলিশকে বলে আসলাম ভাই এম্বুলেন্সে রোগী আছে একটু যাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
পুলিশ জানায়, চারপাশের রাস্তা আটকা, ছাড়ার কোনো উপায় নাই।
গতকাল দিনভর রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের চিত্র ছিল এমনই। বিশেষ করে দুপুরে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের মিছিল সমাবেশকে কেন্দ্র করে তীব্র যানজট দেখা দেয় বিভিন্ন সড়কে। যানজটের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে মানুষকে।
মূলত নগরে বিভিন্ন রাজনৈতিক অনুষ্ঠান থাকার কারণেই এই যানজট দেখা দেয়। বুধবার রাজধানীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নানা কর্মসূচি পালিত হয়। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি এবং গণঅধিকার পরিষদের নেতা রাশেদ খানের ওপর হামলার প্রতিবাদে রাজধানীর পল্টন মোড়ে সমাবেশ এবং বিক্ষোভ মিছিল করে গণতন্ত্র মঞ্চ। আর দুপুরে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ মিছিল করে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ। তেজগাঁও সাতরাস্তা মোড়ে তাদের এই বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এসব মিছিলে হাজার হাজার নেতাকর্মী যোগ দেন। সেইসঙ্গে বিভিন্ন যানবাহনে চেপে আসেন নেতাকর্মীরা।
সকাল থেকেই তীব্র যানজট দেখা দেয়। সবথেকে বেশি যানজট দেখা যায় বাংলামোটর, মালিবাগ, শান্তিনগর, রামপুরা, মেরুল বাড্ডা, উত্তর বাড্ডা, কাওরান বাজার, শাহবাগ, ফার্মগেট, পান্থপথ, নিউ মার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকায়। বড় জটলার পাশাপাশি ধীরগতিতে যানবাহন চলতে দেখা যায়।
গণমাধ্যমকর্মী সাইফুল ইসলাম বেলা ১টা ৩৮ মিনিটে নিজের ফেসবুক ওয়ালে স্ট্যাটাস দেন- আজ খুব প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে বের না হওয়াই ভালো। আমি মোটরসাইকেলে মোহাম্মদপুর থেকে বনানী এসেছি ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিটে। যেখানে লাগার কথা স্বাভাবিক দিনে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, বনানী যাওয়ার পথে আমার মোটরসাইকেলের চাকা পুরোদমে হয়তো একবারও ঘোরেনি। মহাখালী ফ্লাইওভারের ওপরেই আটকে ছিলাম প্রায় এক ঘণ্টা।
বেসরকারি চাকরিজীবী সাইদুর রহমান বলেন, আমি আগারগাঁও থেকে ফার্মগেটে লেগুনায় আসি। সাধারণ সময়ে আমার লাগে ২০ মিনিট। কিন্তু আজ লেগেছে প্রায় দেড় ঘণ্টা। বিজয় সরণি সিগন্যাল পার হতেই লেগে যায় আধাঘণ্টা।
আড়াই ঘণ্টায় মিরপুর-১ থেকে কলাবাগান গেছেন রোদেলা চৈতি। তিনি বলেন, আমার পাঁচটায় টিউশনি ছিল। আমি সাধারণত এক ঘণ্টা আগে চারটায় বের হই। বাসে আমার সময় লাগে ২০ থেকে ৩০ মিনিট। কিন্তু আজ চারটায় বাসে উঠে সাড়ে ছয়টায় কলাবগানে পৌঁছাই। প্রথম টিউশনিটা পড়াতে পারিনি। আরেকটা টিউশনি ছিল লালমাটিয়ায় এরপর সময়মতো পৌঁছাতে না পেরে সরসারি লালমাটিয়া চলে যাই।
মো. নাজমুল বলেন, মহাখালী থেকে কাওরান বাজার আসতে বাসের জন্য দাঁড়িয়েছি। কিন্তু পুরো রাস্তা স্থবির থাকায় ভাবলাম কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বাসে উঠি। কিন্তু একই অবস্থা দেখে নাখালপাড়া দিয়ে হাঁটা শুরু করি। প্রায় এক ঘণ্টায় আসি কাওরান বাজারে।
মূল সড়কে যানজট থাকায় সেই জটের প্রভাব এসে লেগেছে গলির সড়কগুলোতেও। ধানমন্ডি ২৮ নম্বর থেকে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ আসতে দেখা যায়, প্রতিটি সড়ক আটকে আছে। রিকশা থেকে শুরু করে প্রাইভেট কার ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। এ সময় দেখা যায়, পূর্ব রাজাবাজর এলাকায় ছোট গলিতে যানবাহন আটকে দিয়ে নেতাকর্মীরা যাচ্ছেন। নড়তে দেয়া হচ্ছে না বাইসাইকেল অব্দি। তারা ভেঙে ভেঙে প্রায় ২০ মিনিট ধরে এই সড়ক পার হওয়ার পর ছাড়া হয় অন্য যানবাহন। আর পান্থপথ থেকে রাসেল স্কোয়ার দু’পাশের সড়কে ছিল আটকা। দীর্ঘ সময় পরপর চাকা সচল হলেও যানবাহন চলেছে ধীর গতিতে।
এই যানজটের প্রভাব লাগে খিলক্ষেত ও বিশ্বরোড এলাকাতেও। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আদনান আহমেদ বলেন, আমি খিলক্ষেত বাসে উঠে ফার্মগেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। কিন্তু বিশ্বরোড পার হতেই লেগে যায় ৪০ মিনিট। এরপর আর ক্লাসের চিন্তা বাদ দিয়ে হেঁটে ফিরে যাই।
সার্ক ফোয়ারা মোড়ে বিকাল চারটার দিকে দেখা যায়, বিএফডিসি সড়ক থেকে দলে দলে আসছেন নেতাকর্মীরা। সড়কে আটকা শত শত যানবাহন। একই চিত্র শাহবাগমুখী সড়ক ও পান্থপথের দিকের সড়কেও। অবস্থা এমনি বেগতিক যে, পথচারীরাও হাঁটতে পারছেন না স্বস্তিতে। ফুটপাথে লেগে আছে জনজট।
পথচারী আসমা ওয়াদুদ তীব্র রোদ থেকে বাঁচতে ছাতা মাথায় দিয়ে হাঁটছিলেন। তিনি বলেন, রাস্তার যে অবস্থা ফার্মগেট থেকে হাঁটা শুরু করেছি যাবো ইস্কাটন। কিন্তু ফুটপাথের অর্ধেক আটকানো। এতো মানুষ যে ফুটপাত দিয়ে হাঁটাও দায়। আর ছাতা মাথায় যাওয়াতো আরও বিপদ। ছাতা ওপর করে হাঁটতে হাঁটতে হাত ব্যথা হয়ে যায়।