বিখ্যাত একটি গানের কলি এরকম—‘পৃথিবী বদলে গেছে যা দেখি নতুন লাগে।’ আধুনিক যুগের যেন এক বিশাল ট্রান্সফরমেশন হয়েছে, যার ফলে মানুষ এখন বাস্তব সভ্যতার পরিবর্তে স্ক্রিনে ভেসে ওঠা অলীক সভ্যতার দিকে ক্রমশই ধাবিত হচ্ছে। বাস্তব জগতের পাশাপাশি একটি মেকি জগতের আবির্ভাব হয়েছে, সেটি হচ্ছে অনলাইন জগত। অফলাইন জগতের মতো এখানেও সকল প্রকার উপাদান বিদ্যমান। পার্থক্য হচ্ছে অনুভূতির জায়গায়।
সম্প্রতি ২০২২ সালের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানুষ প্রতিদিন গড়ে ৩ ঘণ্টা ১৫ মিনিট স্মার্টফোন ব্যবহার করে। অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে ২২ ঘণ্টা ৭৫ মিনিট সময় স্মার্টফোনের পিছনে ব্যয় হয়। এখন প্রশ্ন হলো দিনরাত মিলে আমাদের হাতে মোট সময় থাকে ২৪ ঘণ্টা। এর মধ্যে ছয়-সাত ঘণ্টা আমাদের ঘুমের জন্য আর তিন-চার ঘণ্টা যদি স্মার্টফোনের জন্য ব্যবহার করি তাহলে সময় বাকি থাকে ১৩ ঘণ্টা অর্থাৎ সময়ের এই উদ্ভূত ঘাটতি আমাদের শান্তির অন্তরায়। স্মার্টফোনের পিছনে ব্যবহৃত সময় মানেই যে সময়ের অপচয় সেটা নয়। মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতা সমস্যার সূচনা করে। ফলাফল হিসেবে পাওয়া যায়—মাথা ব্যথা, চোখের সমস্যা, হতাশা, মনোযোগের ঘাটতি, অতিরিক্ত অস্থিরতা ইত্যাদি। স্মার্টফোনের কিছু কনটেন্ট যুব সমাজকে হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো ফেসবুক, টিকটক, গেমিং, পর্নোগ্রাফি ইত্যাদি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে ফেসবুকের আবির্ভাব হলেও এর ব্যপ্তি এখন প্রয়োজনের সীমানা পেরিয়ে অপ্রয়োজনীয়তার দিকে বেশি এগুছে। এই অ্যাপটি যেন আমাদের স্থির থাকার ক্ষমতা ক্রমশ কমিয়ে দিচ্ছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অবসর সময় কাটানোর জন্য আমরা ফেসবুকের ওয়ালে ঢু মেরে আসি। অবসাদ কমানোর এই উপায় আমাদের অবসাদকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে দিন দিন।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, ফেসবুক ব্যবহারের অভ্যাসটাকে ক্লাসিক্যাল কন্ডিশনিং হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়, অর্থাৎ বারবার নোটিফিকেশন চেক করার জন্য আমাদের অবচেতন মন সিগন্যাল দেয়। ফলে আমরা বারবার নোটিফিকেশন চেক করি। কেউ কেউ এর মাধ্যমে সেলিব্রেটি হওয়ার নেশায় মত্ত। তাদের ফলোয়ার বাড়ানোর জন্য মাঝে মাঝে ট্রেনের ছাদে, বড় বিল্ডিং, বড় টাওয়ারের ছাদ থেকে ভিডিও করে থাকে। এতে প্রায়শই অঘটনের ঘটনা ঘটে। তরুণ প্রজন্মের উন্নতির অন্তরায় হিসেবে যার নাম সবার শীর্ষে তা হল পর্নোগ্রাফি। অবাধে ছেলেমেয়েরা নগ্ন ছবি দেখছে। অপরিপক্ক অবস্থায় এসব আপত্তিকর ছবি অথবা ভিডিও দেখার জন্য তাদের মধ্যে যৌন ক্ষুধা তৈরি হচ্ছে। আর এর ফলে দেশে অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, এর কিছু অংশ আমরা মিডিয়ার বদৌলতে জানতে পারি আর অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনা চাপা পড়ে যায় সময়ের জাঁতাকলে । দেখা যাচ্ছে, তরুণরা পিতা-মাতার কথা শুনছে না, রাত করে বাসায় ফিরছে, মাদকাসক্ত হচ্ছে, একাডেমিক রেজাল্ট ভালো হচ্ছে না ইত্যাদি।
অর্থাৎ বাস্তব দুনিয়া থেকে সরে এসে আমরা অবাস্তব অর্থাৎ অনলাইন দুনিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ছি। পছন্দের বই পড়া, আড্ডা দেওয়া, গান শোনা, পছন্দের জায়গায় ঘুরতে যাওয়া ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে আমরা বাস্তব জগতের বাসিন্দা হওয়ার চেষ্টা করব আর অনলাইন জগতকে যতটুকু আমাদের জীবনের জন্য প্রয়োজন ততটুকু ব্যবহার করব তার বেশি নয়, এটাই হওয়া উচিত বর্তমান সভ্যতার উদ্দেশ্য।