দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। দেশের প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে স্থাপিত হয়েছে ডিজিটাল সেন্টার। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিস আজ ডিজিটাল পদ্ধতিতে কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেছে। সরকারের তথ্য বাতায়নে সংযুক্ত আছে কোটিরও বেশি বিষয়ভিত্তিক কনটেন্ট। চালু হয়েছে জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩, ৯৯৯ প্রভৃতি। জনগণ সহজেই এর সেবাসহায়তাও পাচ্ছে দ্রুততার সঙ্গে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের ডিজিটাল অর্থনীতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে জোরেসোরে। দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত, বাড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে আমরা স্যাটেলাইট স্পেস খাতেও প্রবেশ করেছি। ইতিমধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে। ৯টি কার্যপরিধি নিয়ে এগিয়ে যাবে বহুদূর স্মার্ট বাংলাদেশ টাস্কফোর্স, এটা নিশ্চিত।
ম্যাক্রো ও মাইক্রো অর্থনীতির আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রমে প্রতিনিয়তই নিত্যনতুন প্রযুক্তি যুক্ত করছে। ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের এই বৈশ্বিক যুগে ক্ষুদ্রঋণ খাতের অগ্রগতিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর্থিক বিশেষজ্ঞরা ক্ষুদ্রঋণে প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তিকে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জাদুকরী পথ হিসেবে বিবেচনা করছেন। ইউএনসিডিএফ ২০১৭-১৮ সালে তাদের এক সমীক্ষা রিপোর্টে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ডিজিটাল সিস্টেমের সূচনা এবং অপারেশনাল কাজে মোবাইল ফোন প্রযুক্তির ব্যবহারকে বৃহৎ সুযোগ হিসেবে উল্লেখ করেছে। বৈশ্বিক অর্থায়ন কার্যক্রমে যে প্রযুক্তিগুলো বাঁক বদল করছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ও ডিজিটাল মানি ট্রান্সফারিং সিস্টেম। এছাড়া ক্ষুদ্র আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম আরো স্বচ্ছ ও সহজতর করতে ব্লকচেইন, এসএমএস পদ্ধতি, এমপ্লয়ি ট্র্যাকিং সিস্টেম, ডিজিটাল কাস্টমার সলিউশনসহ নিত্যনতুন প্রযুক্তি যুক্ত করছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ঋণ প্রদান থেকে শুরু করে আদায় এবং অন্যান্য আর্থিক লেনদেন সেবা সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এআই প্রযুক্তি এখন অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। অন্যদিকে ডিজিটাল মানি ট্রান্সফার সিস্টেম শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। পূর্বে ঋণ প্রদান করতে গ্রাহকের ক্রেডিট হিস্ট্রি জানতে হিউম্যান টাচের প্রয়োজন হতো, যা অতিরিক্ত শ্রম ও ব্যাপক ব্যয় সাপেক্ষ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির প্রয়াস প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাপক ক্ষতির মুখে ফেলত। প্রযুক্তির সাহায্যে এখন গ্রাহকের ডিজিটাল হিস্ট্রি পরীক্ষা করে খুব সহজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডঊঋ)-এর তথ্যমতে, জ্বালানি, পরিবহন, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ও ডিজিটাল উৎপাদন—এই পাঁচ খাত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে পারলে বিশ্ব এগিয়ে যাবে বহুদূর। মানুষের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ও বাড়বে। জীবনযাত্রার মান ক্রমাগতভাবে উন্নীত হতে থাকবে।
ব্যবসা-বাণিজ্যই হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রাণশক্তি। আমাদের দেশে প্রচুরসংখ্যক জনবল আছে, কিন্তু পর্যাপ্ত দক্ষ জনসম্পদ নেই। অর্থনীতি ডিজিটাল হলে গ্রাম নিয়ে ভাবতে হবে। গ্রামের মানুষ নিয়ে ভাবতে হবে। গ্রামের মানুষের হাতে সহজে মূলধন তুলে দিতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। জীবনযাত্রা সহজ করার জন্য গ্রামের মানুষকে সচেতন করতে হবে। অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে।
গত ১৩ নভেম্বর, ২০২২ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টা ‘ইন্টার অপারেবল ডিজিটাল ট্রানজেকশন প্ল্যাটফর্ম’ (আইডিটিপি) সেবা ‘বিনিময়’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘শতভাগ মানুষকে ব্যাংক হিসাবের আওতায় নিয়ে আসার অংশ হিসেবে আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে ক্যাশলেস বা নগদ অর্থের লেনদেনবিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করাই বর্তমান সরকারের লক্ষ্যে।’
আবার গত ১৪ নভেম্বর, ২০২২ তারিখে সিরডাপ মিলনায়তনে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (গজঅ) কর্তৃক আয়োজিত ই-সেবা উদ্বোধনকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর মহোদয় বলেছেন, ‘আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সমগ্র বাংলাদেশ হবে একটি ক্যাশলেস সোসাইটি, যা খুবই আশাব্যঞ্জক বক্তব্য। আমরা যখন কোনো প্রয়োজনে বিদেশে যাই, তখন ক্যাশলেস ট্রানজেকশনের নানাবিধ বিষয় আমরা দেখি এবং সুবিধা ভোগ করি, অথচ দেশে ফিরেই আমরা আবারও ম্যানুয়াল ফর্মে চলে যাই।
তাই একবার একটু দেখা দরকার ক্যাশলেস সোসাইটি হলে আমরা কী কী সুবিধা পাব, কী ধরনের অসুবিধাই বা হবে, কী ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে তাতে। পুরো সমাজব্যবস্থা ক্যাশলেস হলে নগদ টাকার ব্যবহার কমে যাবে। এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে অর্থ স্থানান্তর করা সহজ হবে। যেমন :কেউ যদি ব্যাংক থেকে বিকাশে বা অন্য কোনো ডিজিটাল ফর্মে টাকা স্থানান্তর করতে চায়, সেক্ষেত্রে সহজেই তা পারবে। ফলে গ্রাহককে লেনদেনের জন্য ব্যাংকে যেতে হবে না। ক্যাশলেস ট্রানজেকশন করা গেলে অর্থ প্রবাহের ব্যয় কমে যাবে এবং সময় কম লাগবে। নগদ টাকা বহনের ঝুঁকি কমে যাবে। ব্যাংকিং চ্যানেলে ট্রানজেকশন হওয়ায় আর্থিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দুর্নীতি কমে যাবে।
সত্তরের দশকে বাংলাদেশে মানুষের কল্যাণে এনজিগুলোর বহুমুখী উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭৪ সালে রুরাল সোশ্যাল সার্ভিস নামে একটি সরকারি প্রকল্পের আওতায় সুদ ও জামানতবিহীন ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম শুরু করা হয়। অতঃপর পর্যায়ক্রমে বহু এনজিও দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব এনজিও সামাজিক কর্মসূচির পাশাপাশি ক্ষুদ্রঋণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নে কার্যক্রম শুরু করে। অর্থাৎ, অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এনজিওর পাশাপাশি মাইক্রো ফিন্যান্স প্রতিষ্ঠান বা এমএফআই হিসেবে কাজ করতে থাকে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সরকার দেশের এফএফআইগুলোকে রেগুলেশনের লক্ষ্যে ‘মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি’ (এমআরএ) প্রতিষ্ঠা করে। জুন, ২০২২ নাগাদ এমআরএর নিবন্ধনভুক্ত ৭৩৯টি এমএফআই আছে আমাদের দেশে, যাদের দেশব্যাপী বিস্তৃত ২৩৫৪৩টি শাখার মাধ্যমে ২০৬৭১৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী দ্বারা নানামুখী অর্থনৈতিক উন্নয়নমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির এখনো মূল চালিকাশক্তি কৃষি খাত। কৃষি খাতে এনজিও-এমএফআইসমূহ প্রতি বছর গড়ে ১ লাখ কোটি টাকা প্রায় ২ কোটি কৃষক পরিবারে বিতরণ করে থাকে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসম্মতভাবে অধিক ফলনযোগ্য কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে কারিগরি সহায়তা ছাড়াও এগ্রিকালচার মেকানাইজেশনে সহায়তা করে। কৃষি খাতে নিয়োজিত এনজিও-এমএফআইয়ের গ্রাহকেরা মূলত ব্যাংক ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। কৃষি খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের ক্যাশলেস ট্রানজেকশনের আওতায় আনতে হলে এনজিওর বিকল্প নেই। তাছাড়া দেশের ৮০ শতাংশেরও বেশি অনানুষ্ঠানিক সেক্টরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী অতিদরিদ্র, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ এবং অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর এলাকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় এনেছে এনজিও-এমএফআইসমূহ। সব মিলিয়ে সরকারের এই উত্তম লক্ষ্য অর্জনে সরকার ও এনজিও-এমএফআইসমূহ যৌথভাবে নগদ লেনদেনবিহীন সমাজব্যবস্থায় যুগপত্ভাবে কাজ করতে পারে।
নগদ লেনদেনবিহীন সমাজ বা ক্যাশলেস সোসাইটি ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য দরকার সর্বস্তরের মানুষকে সচেতন করা। বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত মানুষকে সচেতন করা। ক্যাশলেস ট্রানকেজশনের সুবিধাদি প্রচার করা ও মোবাইল ডিভাইসভিত্তিক করণীয় বুঝিয়ে দেওয়া। আর এসব কাজ শুধু সরকার করতে চাইলে তিন-চার বছরে তা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। এ কাজে দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তথা এনজিও এমএফআইগুলোকে সম্পৃক্ত করা হলে দ্রুততার সঙ্গে সফলতা আনা সম্ভব।
স্মার্ট কৃষি, স্মার্ট শিক্ষা, স্মার্ট ব্যবসার ধারণা যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে ডিজিটাল অর্থনীতি সত্যিকার অর্থে কল্যাণকর হয়ে উঠবে। কৃষিতে ফসল পর্যবেক্ষণ, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং উচ্চফলনশীল করার পদক্ষেপ, শিক্ষার নানা রকম আধুনিয়কায়ন, কারিগরি তথা হাতে-কলমে শিক্ষার প্রসার আমাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেবে অনেক। সমাজের প্রতিটি স্তরে মূল্যেবোধ, মানবিক ও নৈতিক শিক্ষার সংশ্লেষণ। তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি বিভিন্ন দক্ষতার উন্নয়নসংক্রান্ত উদ্যোগের সঙ্গে গ্রামীণ সমাজকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে আমরা সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে সত্যিকার অর্থেই গড়ে তুলতে পারি ডিজিটাল অর্থনীতি এবং সমৃদ্ধ করতে পারি আমাদের জাতিকে।