সে সময় আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি আগরতলা থেকে কলকাতা হয়ে ৯ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যোগদান করি এবং জাফলংয়ে ২৫ দিনের সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে ৯ নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টেন হুদার অধীনে সরাসরি পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে লিপ্ত হই। তন্মধ্যে কালিঞ্চি নদীর যুদ্ধে আমি আহত হই। হাসপাতালে চিকিৎসার পর মে মাসে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপনডেন্ট হিসেবে আমাকে নিয়োগ করা হয়। মুজিবনগর সরকারের চিফ সেক্রেটারি হিসেবে প্রশাসন চালাতেন আমার মামা রুহুল কুদ্দুস। তিনি ফোর্ট উইলিয়ামে অবস্থিত ইস্টার্ন সেক্টরের কমান্ডার জেনারেল অরোরাকে বলে দেওয়ায় আমার জীবনে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ ঘটে। সেখান থেকে যখনই ইন্ডিয়ান আর্মি হেলিকপ্টার যে কোনো সেক্টরে যেত, আমি তাতে উঠে যেতে পারতাম। ফলে মে মাস থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে দিনরাত এক ফ্রন্ট থেকে আরেক ফ্রন্টে উল্কার বেগে চলাচল ছিল আমার।
স্বাধীন বাংলা বেতারের পরিচালক শামসুল হক ও প্রোগ্রাম অরগানাইজার আশরাফ ভাই (‘রণাঙ্গন ঘুরে এলাম’ এর প্রযোজক) বার্তা বিভাগে শ্রদ্ধেয় লোহানী ভাই এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আনোয়ারুল হক খান অপেক্ষা করে থাকতেন ফ্রন্ট থেকে আমার পাঠানো একটি সফল অপারেশনের খবরের জন্য। প্রতি সপ্তাহে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে স্বকণ্ঠে আমার প্রচারিত ‘মুক্তাঞ্চল ঘুরে এলাম’ ও ‘রণাঙ্গন ঘুরে এলাম’ কথিকা দুটি প্রচারের জন্যও ওয়ার ফ্রন্টের সংবাদ সংগ্রহ করা আমার জীবনের একমাত্র ব্রত হয়ে উঠেছিল। দুঃসাহসিক এ রকম বহু সাফল্যের পর অকস্মাৎ আমার জীবনে দুর্ভাগ্য নেমে আসে ৮ নম্বর সেক্টরের চাঁচড়ায়। যখন আমার জীবন-মৃত্যুর ব্যবধান ছিল এক সুতার ব্যবধান মাত্র। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ৮ নম্বর সেক্টরে ভারতীয় সাংবাদিক জ্যোতি সিংসহ পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন এবং পাকিস্তানি সেনারা তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাবার পর তিনি মারা গেছেন বলে যশোরের চাঁচড়া স্কুলের ঘরে ফেলে রেখে যায়। সেখান থেকে আমাকেও অজ্ঞান ও মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
এভাবে লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধা ও লাখ লাখ বাঙালি ভাইবোনের আত্মদান ও রক্তস্রোতের ওপর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের দিন এগিয়ে আসতে লাগল। ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের সম্মিলিত মিত্রবাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নব অধ্যায়ের সূচনা করল। এরপর ১১টি সেক্টর থেকে আমাদের মহাবীর সেক্টর কমান্ডারদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বীরদর্পে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে ঢাকা অভিমুখে মার্চ করে চলল। এসে গেল ইতিহাসের সেই মহত্তম মুহূর্ত। ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শত-সহস্র বাঙালি ভাইবোনের জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল নিয়াজী, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করলেন।
আমি সেদিন ঢাকার সেই আত্মসমর্পণ প্রত্যক্ষ করতে পারিনি। কিন্তু পরদিন ১৭ই ডিসেম্বর খুলনার সার্কিট হাউজ ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ৩০ হাজার (দিনাজপুর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, বরিশাল, পটুয়াখালী, যশোর ও খুলনার পাকিস্তানি বাহিনীর সম্মিলিত ফোর্স) অফিসার ও সৈনিক আত্মসমর্পণ করে, সে অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত ছিলাম। স্বাধীন বাংলা বেতারের পক্ষ থেকে সেখানে আমি মিত্রবাহিনীর জেনারেল দেলবার সিংয়ের সঙ্গে হেলিকপ্টারে পৌঁছাই। সেখানে যশোর ক্যান্টনমেন্টের ১০৭ ব্রিগেডের হায়াত খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করে।
১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট নিক্সন বাংলাদেশ বিষয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেন। তিনি বাংলাদেশকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দুই দেশকে সন্তুষ্ট করার প্রস্তাব দেন। যেভাবে অতীতে জার্মানি, কোরিয়া, ভিয়েতনামকে ভাগ করে বিশ্ব শান্তি রক্ষা করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বেজনেভ এজন্য দুই সপ্তাহ সময় নেন। তিনি তার পররাষ্ট্র মন্ত্রী আঁদ্রে গ্রোমিকোকে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক বিমানে দিল্লি প্রেরণ করেন যাতে তিনি সামরিক গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবটি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে দিতে পারেন। ইন্দিরা গান্ধী তাকে দিল্লিতে অবস্থান করতে বলেন এবং কলকাতা থেকে ২৭ নভেম্বর রাতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে দিল্লিতে আনার জন্য ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমান প্রেরণ করেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং মুজিবনগর সরকারের মুখ্য সচিব আমার মামা রুহুল কুদ্দুস সন্ধ্যা ৭টায় দিল্লি পৌঁছান। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি তাদের ইন্দিরা গান্ধীর অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বাংলাদেশ বিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত ভারতের পরিকল্পনা মন্ত্রী শ্রী ডি পি ধর এবং ইন্দিরাজির মুখ্য সচিব শ্রী পি এন হাকসার উপস্থিত ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাত শেষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত মলিন ও বিমর্ষচিত্তে বেরিয়ে আসেন। পরে জানা যায়, তাজউদ্দীন ইন্ধিরা গান্ধীকে করজোড়ে বলেছেন যে, তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবেন কিন্তু বাংলাদেশের কোনো বিভক্তি মেনে নিতে পারবেন না। এটা হবে তার আত্মহত্যার শামিল।
২৭ এবং ২৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট বেজনেভের গোপন আলোচনা হয়। সে আলোচনায় ইন্দিরা গান্ধীর কাছে প্রেসিডেন্ট বেজনেভ এই মর্মে নিশ্চয়তা চান যে, ১৫ দিনের মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢাকা দখল করতে সমর্থ হবে কি না। তা নাহলে পারমাণবিক যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রস্তাবে সম্মত হওয়ার বিকল্প প্রস্তাব ইন্দিরা গান্ধীর কাছে কী আছে? রাশিয়ার সর্বাত্মক সামরিক সহায়তা পেলে তার ফোর্স ১৫ দিনের মধ্যে ঢাকা দখল করতে সমর্থ হতে পারে বলে ইন্দিরা গান্ধী জানান। প্রেসিডেন্ট বেজনেভ নভোমণ্ডলে অবস্থিত তার শতশত স্পুটনিক (গোয়েন্দা ক্যামেরা) বাংলাদেশের ওপর নামিয়ে আনার জন্য নভোমণ্ডল সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিকদের নির্দেশ দেন। ফলে সমগ্র বাংলাদেশের শহর, বন্দর, সড়ক, মহাসড়ক, লেন বাই লেন এবং বিশেষ করে, সব ক্যান্টনমেন্ট এবং রাজধানী ঢাকার প্রতি ইঞ্চি জায়গায় কোথায় কী হচ্ছে বা কোথায় কারা চলাচল করছে বা কোন এলাকা পাকিস্তানি বাহিনী মুক্ত তা তারা দিল্লিতে বসে খবর পেয়ে যাচ্ছিলেন।
অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের শেষ ১৫ দিনে অলৌকিকভাবে ঢাকা দখল হয়ে যায় এবং জেনারেল নিয়াজি প্রায় ১ লাখ সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। এর পেছনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, প্রেসিডেন্ট বেজনেভ এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সৃজনশীল নেতৃত্ব ছিল। বিশ্বের কোটি কোটি বঙ্গজননী, যে যেখানে আছেন, ১৬ই ডিসেম্বরের পুণ্য প্রভাতে আপনার কোলের শিশুর কপালে আজ পরিয়ে দিন জয়টিকা। জয় বাংলা।