ব্যাংককে বলা হয় অর্থনীতির ধারক ও বাহক। অসংখ্য প্রান্তিক মানুষের সঞ্চয়ের শেষ ভরসা হলো ব্যাংক। মাটির ব্যাংকে এক সময় মানুষ অল্প স্বল্প টাকা জমা করত। এখন মানুষের সঞ্চয়ের ধরন ও অভ্যাসের অনেক পরিবর্তন হয়েছে এবং সঞ্চয়ের প্রবণতা ব্যাংকমুখী। ব্যাংকিং খাত দেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং, উপশাখা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। এসব কারণে এর আওতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। একই সঙ্গে বাড়ছে ব্যাংকিং খাতের সার্বিক সেবামান। ব্যাংকিং ব্যবস্থা হচ্ছে ডিজিটাল ও আধুনিকায়ন। মানুষ দ্রুত ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছে। যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় চালিকাশক্তি হলো ব্যাংকিং খাত। অর্থ গচ্ছিত রাখা, অর্থ লেনদেন করা, বিভিন্ন ধরনের ঋণসেবা প্রদান, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ নিশ্চিত করা, এসএমই-এর উন্নয়নসহ নানাবিধ কার্যক্রমে ব্যাংকিং খাত সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে থাকে।
সম্প্রতি ব্যাংকিং সম্পর্কে গণমাধ্যমে কিছু নেতিবাচক খবর গ্রাহকদের মধ্যে ভয়, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তৈরি করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি গুজব আকারে আরও অতিরঞ্জিত হয়ে শহর, বন্দর ও প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। ঋণ বিতরণের কিছু অনিয়মকে লুটপাট, ব্যাংক ডাকাতি, ব্যাংক দেউলিয়া—এসব শব্দ ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করা হয়েছে। ফলে গ্রাহকরা আতঙ্কিত হয়ে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা উত্তোলন করে নিজেদের বাসাবাড়ি ও অফিসে রাখতে শুরু করেছেন। আসলে এ ধরনের ঘটনা অর্থ এবং গ্রাহকদের জীবন দুটোর জন্যই অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ব্যাংকে টাকা নেই, এমন কথা গুজব আকারে ছড়ানো হয়েছে। তাই সাধারণ গ্রাহক আতঙ্কে ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। এখন অবশ্য সেই গ্রাহকরাই আবার ব্যাংকে টাকা রাখতে শুরু করেছেন। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকে আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ, কোনো টাকার সংকট নেই—এমন বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে গ্রাহকদের আশ্বস্ত করতে বাধ্য হয়েছে।
ব্যাংক ইচ্ছা করলেই সংগৃহীত আমানতের সবটাই ঋণ হিসেবে বিতরণ করতে পারে না, ব্যাংকে জমাকৃত আমানতের একটি নির্দিষ্ট অংশ রিজার্ভ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে; যা আপত্কালীন তহবিল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ব্যাংকের সম্ভাব্য তারল্য সংকটে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব সময় ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে থাকে। আমানতদারীদের স্বার্থ রক্ষাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল দায়িত্ব। এজন্য ব্যাংক ব্যবস্থায় তীক্ষ্ণ নজরদারি বিদ্যমান এবং সর্বোপরি ব্যাংক ব্যবস্থা বিভিন্ন বিধিবিধান-আইন দ্বারা সুরক্ষিত এবং জনগণের জমা অর্থের নিরাপত্তা রক্ষায় সরকারের সর্বোচ্চ সতর্কতা রয়েছে। সেক্ষেত্রে আমানতের সুরক্ষা নিয়ে আতঙ্ক অমূলক।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের অক্টোবরের শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানত ছিল ১২ লাখ ৫১ হাজার ১২০ কোটি টাকা, যা ২০২১ সালের অক্টোবরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৮৮ হাজার ৬২ কোটি টাকা এবং এ সময়ে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। অন্যদিকে চলতি বছরের অক্টোবরে তা আরও বেড়ে হয়েছে ১৪ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। একই সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের অক্টোবরে ব্যাংকের ঋণ ও বিল (আমদানি ও অভ্যন্তরীণ) ছিল ১১ লাখ ১৭ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা। ২০২১ সালের একই মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ লাখ ২২ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। করোনার এক বছরে ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। অন্যদিকে চলতি বছরের অক্টোবরে এসে ঋণ ও বিল বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ লাখ ৩৪৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত এক বছরে ঋণ ও বিল বেড়েছে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মানুসারে ব্যাংকগুলো যে আমানত সংগ্রহ করে তার ১৭ শতাংশ সিআরআর (নগদ জমা হার) ও এসএলআর (বিধিবদ্ধ জমা) হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। আর ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো সাড়ে ৯ শতাংশ আমানত জমা রাখে। বাকি অর্থ ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে বা বিনিয়োগ করতে পারে। সে হিসেবে ব্যাংকগুলোর হাতে সিআরআর ও এসএলআর রাখার পর ২০২০ সালের অক্টোবরে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা, যা ২০২১ সালের একই মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ২০ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে অতিরিক্ত তারল্য অবশ্য কমে ১ লাখ ৭০ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। অর্থাৎ ১১ মাসে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে ৫০ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংক ও পুঁজি বাজার একটি মূল্য সংবেদনশীল খাত এবং এসব খাত সম্পর্কে কোনো সংবাদ পরিবেশন করতে হলে সেটা আগে যাচাই-বাছাই করে বাজার ব্যবস্থা ও ভোক্তা সাধারণের ওপর কী পরিমাণ প্রভাব বিস্তার করে তা চিন্তা করা দরকার। আসলে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য বলতে বোঝায় যেসব তথ্য যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একটি কোম্পানির সঙ্গে সম্পর্কিত এবং যা প্রকাশিত হলে কোম্পানির সিকিউরিটিজের মূল্যকে বস্তুগতভাবে প্রভাবিত করতে পারে। ব্যাংকিং খাতের আমানত, ঋণস্থিতি, আমদানি রপ্তানি, রেমিট্যান্স প্রবাহ ইত্যাদি দেশের অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এসব খাতে কোনো অনিয়ম বা নিয়মের ব্যত্যয় হলে সেটা দেখার জন্য নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা মন্ত্রণালয়, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আছে। কিন্তু তার আগেই যদি গণমাধ্যম ঐসব প্রতিষ্ঠানকে অপরাধী সাজানোর চেষ্টা করে, তবে তা ভোক্তা সাধারণের কাছে ভুল বার্তা বহন করে, যেটা সাম্প্রতিক সময়ে ঘটেছে এবং গ্রাহকরা আতঙ্কিত হয়ে নগদ টাকা উত্তোলন করে নিজেদের কাছে গচ্ছিত রাখছে। এটা দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতের জন্য ইতিবাচক খবর নয়। ব্যাংকিং খাতের কোনো অন্যায় বা অনিয়ম দৃশ্যমান হলে গণমাধ্যম প্রকাশ করবে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা যেন অহেতুক ভয়, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও গুজব তৈরি করে গ্রাহকদের ভুল বার্তা না দেয়. সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অপরাধ বা অনিয়ম প্রকাশ বা তদন্তের আগেই যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তবে তা সত্যিই উদ্বেগজনক।
অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক বা ব্যাংকিং সেবা প্রান্তিক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সরকার মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং, উপশাখা, এটিএম, ডিজিটাল ওয়ালেট ইত্যাদি সেবা চালু করেছে এবং এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে স্বল্প বা বিনা খরচে আর্থিক তথা ব্যাংকিং সেবায় অন্তর্ভুক্ত করা। এই সেবার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো কৃষকদের জন্য মাত্র ১০ টাকায়, তৈরি পোশাক শ্রমিক বা স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য ১০০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার বিধান। বিগত কয়েক বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় এসব নতুন সেবা চালু হওয়ার পর আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মকাণ্ডের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। যেখানে ২০০৮ সালের শেষে ব্যাংকগুলোতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৭৬ লাখ, ২০১৩ সালের শেষ ভাগে এসে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ কোটির বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ কোটি ৯৫ লাখ ১৪ হাজার ৫১৩টি এবং এসব হিসাবে জমা ছিল ১৫ লাখ ৭৩ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে দেশের অর্থনীতির মস্তিষ্ক বা হৃৎপিণ্ড বলেও অভিহিত করে থাকেন। দেশে যত উন্নয়ন ও অগ্রগতি হয়েছে, তার পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে ব্যাংকিং খাত। একই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের অনেক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। খেলাপি ঋণ, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করা ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য অনেকে দেশের আর্থিক খাতের সংস্কারের কথা বলছেন। তবে এটাও সত্য, ব্যাংক বা আর্থিক ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অটল আস্থা অত্যন্ত জরুরি। আস্থা নষ্ট হলে কিংবা প্রান্তিক মানুষ ব্যাংক বিমুখ হলে সেটা গোটা অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ।
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, অতিসম্প্রতি ব্যাংকিং খাত নিয়ে যেভাবে নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে, তা গ্রাহকদের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে। ব্যাংকগুলো বন্ধ বা হিসাবের টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে, ব্যাংকে ১ লাখ টাকার চেকও ক্যাশ হচ্ছে না—ব্যাংক নিয়ে এমন কিছু গুজব ছড়ানো হয়েছে অনলাইনে। প্রবাসীদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে নিরুত্সাহী করা হচ্ছে। বৈধ পথের বিকল্প হিসেবে অবৈধ হুন্ডি ব্যবসায়কে চাঙ্গা করার একটা প্রবণতা সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ব্যাংক নিয়ে গুজব, অবৈধ হুন্ডিকে উত্সাহ দেওয়ার ধারাবাহিক প্রবণতায় কিছুটা হলেও প্রভাব পড়েছে। বেশির ভাগ গুজব মানুষ বিশ্বাস না করলেও একশ্রেণির মানুষ ঠিকই বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গেছেন। ফলে অনেকেই ভয় ও আতঙ্কিত হয়ে নগদ অর্থ উত্তোলন করে নিজেদের কাছে গচ্ছিত রাখছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। এভাবে চলতে থাকলে তা ব্যাংকিং খাতের তারল্য প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে ব্যবসায়-বাণিজ্যে স্থবিরতা নিয়ে আসতে পারে। এজন্য এ মুহূর্তে ভয়, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দূর করে যে কোনো মূল্যে গ্রাহকদের ব্যাংকমুখী করতে হবে।