স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ; সত্যিকার অর্থেই সারা বিশ্বের বিস্ময় আর আমাদের অহংকার। সারা বিশ্বকে বিস্মিত করে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে পরাস্ত করে পৃথিবীর বুকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে বাংলাদেশের। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর, টানা নয় মাস চলে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির মুক্তির গৌরবমণ্ডিত সশস্ত্র এ যুদ্ধ
১০ এপ্রিল গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে করা হয় এ সরকারের প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে অন্য সহকর্মীদের নিয়ে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরের আমবাগানে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণ করেন। সেনাপতি (কমান্ডার-ইন-চিফ) নিযুক্ত হন কর্নেল এম এ জি ওসমানী (আতাউল গনি ওসমানী)।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের আগুনঝরা দিনগুলিতে প্রতিবেশী ভারতসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র আমাদের পাশে দাঁড়ায়। এসব বন্ধুরাষ্ট্রের সমর্থন ও সক্রিয় সহযোগিতা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াইয়ে আমাদের বিপুল শক্তি জোগায় এবং কাঙ্ক্ষিত বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।
আমাদের কাছে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। একই সঙ্গে সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম।
বৃহত শক্তি হিসেবে আমাদের পরীক্ষিত বন্ধুরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল লিওনিদ ব্রেজনেভ, প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি ও প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণযোগ্য।
এ সময় সাহায্য-সহযোগিতার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে বিশ্বজনমতের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য যাবতীয় কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হয় প্রধানত লন্ডন ও নয়াদিল্লি-ভিত্তিক। ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্মানের সঙ্গে নিরাপদে দেশে ফেরার যাবতীয় বন্দোবস্ত করে দেন। এছাড়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড হিথ ৯ জানুয়ারি ১৯৭২ ক্লারিজেস হোটেলে এসে আমাদের মহান নেতাকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানান।
তাদের কেউ-ই আজ আর বেঁচে নেই। বন্ধুপ্রতিম এমন সব রাষ্ট্রের হৃদয়বান অনেক ব্যক্তিই তাদের কীর্তিকলাপের মাধ্যমে আমাদের বিজয়গৌরবের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে রইলেন। স্বাধীনতার মাসে তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
পূর্ববঙ্গের প্রতি দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে শাসন-শোষণ, বৈষম্য-বঞ্চনা আর অত্যাচার-নির্যাতনের পর ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর আগেই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে দীর্ঘদিনের সামরিক শাসক জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়ে যেতে বাধ্য হন এবং তার স্থলাভিষিক্ত হন জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আদেশেই নির্বাচন এবং তার প্রত্যক্ষ মদদে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রসহ বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে যাবতীয় সব হৃদয়বিদারক নাটকীয় ঘটনা। ২৫শে মার্চ কালরাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’, বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার ও ৯টি মাস ধরে দেশব্যাপী ব্যাপক গণহত্যা, নারীর সম্ভ্রমহানি, অগ্নিসংযোগ-লুটতরাজ ও ধ্বংসযজ্ঞ; এ সবকিছুই ইয়াহিয়া খানের দুষ্কর্মকাণ্ড। এছাড়া আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের আগুনঝরা দিনগুলিতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিচার্ড নিক্সন। এ সময়কার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। ইয়াহিয়া খানের শক্ত খুঁটির জোর ছিল উল্লিখিত নিক্সন-কিসিঞ্জার তথা আমেরিকা।
চীন বিশ্বের অন্যতম বৃহত শক্তি এবং দূরত্ব বিচারে আমাদের নিকটতম। কিন্তু বাঙালি জাতির ঘোর দুর্দিনে শক্তিধর আমেরিকার মতোই চীনও আমাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন এবং শক্তি বৃদ্ধিতে ইন্ধন জোগায়। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান ছিলেন মাও সে তুং। এ সময় চীনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন চৌ এন লাই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও অর্থদানসহ চীন আক্রমণকারী পাকিস্তানকে সর্বতোভাবে সাহায্য করে। এতসব বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণার পর ৯ মাস মরণপণ যুদ্ধ হয়। অপরিমেয় প্রাণক্ষয় ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে শেষ পর্যন্ত ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের তরি কূলে এসে ভেড়ে। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রিয় বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ, অপরিমেয় ত্যাগ-তিতিক্ষা, সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট-বিড়ম্বনা, পক্ষ ও বিপক্ষ-শক্তি এ সবকিছুই আজ ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ।
ডিসেম্বর বাঙালির বিজয়ের মাস। গৌরবের পুণ্যলগ্নে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি অকাতরে আত্মদানকারী শহিদ ও অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ ত্যাগী এবং ভাগ্যবিড়ম্বিত নরনারীদের।
সুপ্রভাত বাংলাদেশ।