গত ছয় বছরে দেশের গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। সেটি যদি ৫ শতাংশেও নামে, তাতেও ২০৪০ সালের মধ্যেই ১ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির মাইলফলক স্পর্শ করবে বাংলাদেশ। আর প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ হলে ২০৩০ সালেই সেখানে পৌঁছানো সম্ভব। বিপুল ভোক্তাশ্রেণি ও তরুণ জনগোষ্ঠী, উচ্চমাত্রায় অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা, মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা, ডিজিটাল ব্যবস্থায় অগ্রগতি, বেসরকারি খাতের দ্রুততর বিকাশ—এসবের বদৌলতে একের পর এক অর্থনৈতিক সফলতা পাচ্ছে বাংলাদেশ।
এখন বলা হচ্ছে, দেশের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রায় মূল চালিকাশক্তি হবে বেসরকারি খাত। এখান থেকে উদীয়মান চ্যাম্পিয়নরা তৈরি হচ্ছে। তারা বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। সমাজেও তাদের প্রভাব আছে। গ্লোবাল ম্যানেজমেন্ট কনসালটিং ফার্ম বোস্টন কনসালটিং গ্রুপের (বিসিজি) সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় এসব চিত্র উঠে আসে। বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে করা ঐ সমীক্ষার ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে তারা সম্প্রতি। বাংলাদেশকে উদীয়মান পাওয়ার হাউজ বা শক্তিকেন্দ্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বিসিজি। তাদের মতে, এই শক্তিকেন্দ্রের ভিত বা পিলার আটটি। সেগুলো হচ্ছে—দৃঢ় আশাবাদ, ভোক্তাশ্রেণির উত্থান, ক্রমবর্ধমান তরুণ কর্মশক্তি, অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবণতা বা ঘাতসহতা, ডিজিটাল অর্থনীতির গতি, সরকারি বিনিয়োগ, বেসরকারি খাত, উদীয়মান অর্থনীতি (ইন্টারনেটভিত্তিক খণ্ডকালীন কাজ)।
বাংলাদেশের ভোক্তাদের আশাবাদ অনেক বেশি। তারা মনে করে, ভবিষ্যতেও তাদের ক্রয়সক্ষমতা থাকবে। এই আশাবাদ বিগত দশকে দেশকে উচ্চ প্রবৃদ্ধির অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়তা করেছে, যদিও সাম্প্রতিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে সেই আশাবাদ কিছুটা নিম্নমুখী। সবার প্রত্যাশা, অর্থনীতির দক্ষতাভিত্তিক রূপান্তরের কারণে আগামী প্রজন্ম উন্নত জীবন যাপন করতে পারবে। গত ৩০ বছরে দেশে বড় ভোক্তাশ্রেণি তৈরি হয়েছে। গত শতকের ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে এবং বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়। তৈরি পোশাক খাত, ওষুধসহ রপ্তানিমুখী শিল্প গড়ে ওঠে। দারিদ্র্য দ্রুত কমতে শুরু করে। ভোক্তাশ্রেণি গড়ে ওঠে। বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৬৯ শতাংশ জোগান দিচ্ছে অভ্যন্তরীণ ভোক্তাশ্রেণি। আগামী ২০৩০ সালে যুক্তরাজ্য ও জার্মানিকে টপকে বাংলাদেশের ভোক্তাশ্রেণি বিশ্বের নবম বৃহত্তম হবে। এ ছাড়া ২০২৫ সালে বাংলাদেশের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রবৃদ্ধি ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের চেয়েও বেশি হবে। গত ২০২০ সালে বাংলাদেশে উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ, যা ২০২৫ সালে ৩ কোটি ৪০ লাখে গিয়ে দাঁড়াবে। বিপুলসংখ্যক তরুণ কর্মশক্তি বাংলাদেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখার জন্য প্রস্তুত।
বাংলাদেশের মানুষের গড় বয়স বর্তমানে ২৮ বছর, যা ইন্দোনেশিয়ায় ৩১, ভারতে ২৯, থাইল্যান্ডে ৩৯, ভিয়েতনামে ৩২ বছর। এক্ষেত্রে বৈশ্বিক গড় ৩০ বছর। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ বা ৬৮ দশমিক ৪ শতাংশ কাজের উপযোগী। এর মানে, ১১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ কর্মক্ষেত্রে মূল্য সংযোজনে প্রস্তুত। বাংলাদেশের পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক ঘাতসহতা অনেক বেশি। সেই সঙ্গে জাতীয় ঋণের পরিমাণ কম হওয়াও একরকম আশীর্বাদ বটে। এ দেশের মানুষের সঞ্চয়ের হার বিশ্বের গড় হারের চেয়ে বেশি। এখানকার মানুষের সঞ্চয়ের হার মোট জাতীয় আয়ের ৩৪ শতাংশ, যেখানে বৈশ্বিক হার ২৭ শতাংশ। এ ছাড়া জিডিপির প্রায় ৬৯ শতাংশ অভ্যন্তরীণ ভোগ থেকে আসার কারণে বাহ্যিক নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি একরকম সুরক্ষিত রয়েছে। আবার সমপর্যায়ের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় ঋণের পরিমাণও কম, তা জিডিপির মাত্র ১৯ শতাংশ। অন্যদিকে জাতীয় ঋণ ভিয়েতনামে ৩৯, ইন্দোনেশিয়ায় ৪১, থাইল্যান্ডে ৫৩, ভারতে ৫৬ ও ফিলিপাইনে ৬১ শতাংশ। উচ্চ সঞ্চয়ের কারণে ২০২১ সালে এ দেশের গ্রস ফিক্সড ক্যাপিটাল ফরমেশনের হার ছিল জিডিপির ৩১ শতাংশ, যা এশিয়ার অন্যান্য সমপর্যায়ের দেশের তুলনায় বেশি। আবার প্রবাসী আয় আসার উচ্চগতি অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতা দিয়েছে। ২০২০ সালে ১ হাজার ১০০ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল, যা গত বছর দ্বিগুণ বা ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার হয়েছে।
বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতির গতি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ডিজিটাল মাধ্যমে ভোক্তাদের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। গত ১০ বছরে মোবাইল ফোনের গ্রাহকসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২১ সালে মোবাইল ফোনের মোট গ্রাহকসংখ্যা ছিল ১৭ কোটি ৭০ লাখ। এ ছাড়া গত এক দশকে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। ডিজিটাল অর্থনীতির পরিবেশ উন্নত হওয়ায় প্রযুক্তির মাধ্যমে আর্থিক সেবায় লেনদেন ৩৫০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। ২০১৯ সালে যা ছিল ১৭০ কোটি ডলারের কাছাকাছি। তার মানে, চার বছরের ব্যবধানে তা দ্বিগুণ হয়েছে। সরকারের সক্রিয় ভূমিকাও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রেখেছে। গত এক দশকে সরকারের ব্যয় চার গুণ বেড়েছে। ২০১২ সালে যেখানে সরকারের ব্যয় ছিল ৫৩ হাজার ২০০ কোটি ডলার, সেখানে তা চলতি বছরে বেড়ে ২ লাখ ২৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলার হয়েছে। সেই সঙ্গে বিগত কয়েক বছরে সরকারের প্রচেষ্টায় এ দেশে সাক্ষরতার হার ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আবার মাথাপিছু বিদ্যুৎ সরবরাহ ৩০০ কিলোওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। এ ছাড়া বড় কিছু পরিকল্পনা যেমন—স্মার্ট বাংলাদেশ আইসিটি ২০৪১ ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নেবে। বাংলাদেশের বেসরকারি খাত সম্প্রসারণশীল, যা প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি। বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অনেক বড় হয়েছে, যাদের কারণে দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলেই মনে করছে বিসিজি। বৈশ্বিক বস্ত্র ও পোশাক খাতের সরবরাহ ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী। এই খাতের আরও প্রবৃদ্ধি হবে।
কারণ, বড় বড় পোশাক রপ্তানিকারকেরা বিশ্বব্যাপী বাজার সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে। দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের বিকাশ হয়েছে। যদিও মাত্র তিনটি কোম্পানির হাতেই সিংহভাগ বাজার। তাদের হাত ধরে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের নবম বৃহত্তম মোবাইল বাজার। দেশের প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ভূমিকা আছে বেসরকারি সংস্থার (এনজিও)। এর মধ্যে বিশেষ করে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় এনজিও ব্র্যাক ও ক্ষুদ্রঋণের অগ্রগামী গ্রামীণ ব্যাংক সমাজের একদম নিচুতলার মানুষের সুরক্ষা দিচ্ছে। গত এক দশকে বাংলাদেশে স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোও বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। দেশে এখন স্টার্টআপ কোম্পানির সংখ্যা ১ হাজার ২০০। স্টার্টআপগুলো বিভিন্ন খাতে ব্যবসা করছে, যার মধ্যে আছে প্রযুক্তির মাধ্যমে আর্থিক সেবা, ই-কমার্স ও লজিস্টিকস। স্টার্টআপ খাত প্রায় ৭০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছে। সরকারও স্টার্টআপ বাংলাদেশ নামে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল তহবিল গঠনের মাধ্যমে খাতটিকে পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি নানাভাবে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বড় শিল্প গ্রুপের অবদান কম নয়। অবশ্য কোনো আখ্যানই একরৈখিক নয়, উত্থান-পতন সব জাতির জীবনেই আসে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার সংকটসহ মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। আগামী অর্থবছরেও সংকট আরও বাড়তে পারে। গত ১০-১৫ বছরে অর্থনীতিতে এমন চাপ দেখা যায়নি। এই পরিস্থিতিতে কিছু অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকটা ভালো অবস্থানে আছে। তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।