সারা বিশ্বে লিওনেল মেসির নামে মাতম উঠেছে। একদল ফুটবল সমর্থক হংকং থেকে দোহায় এসেছে প্রিয় ফুটবলারের হাতে কাপ দেখার আশায়। সুদানের রশিদের মনে ফুটবলপ্রেম জেগেছে মেসির খেলা দেখে। এমনকি ব্রাজিলীয় রেডিও সাংবাদিক আলিনি ফানেল্লির মনেও কোনো দ্বিধা নেই, ‘লিওনেল জিতলেই ভালো হয়।এর অন্যথা হলে আজ শোক নেমে আসবে ফুটবলবিশ্বের বড় একটা অংশে। সেই শোক আছড়ে পড়বে বাংলাদেশেও। একদিকে মেসি, অন্যদিকে বিশ্বকাপ। মাঠের দ্বৈরথে এমবাপ্পে থাকলেও মানুষের আবেগে লড়াইটা হয়ে গেছে বিশ্বকাপ বনাম মেসির। চারদিক এই আর্জেন্টাইন জাদুকরের নামে এমন জয়ধ্বনি হচ্ছে, তাঁর হাতে কাপ না উঠলে যেন বিশ্বকাপেরও মান থাকে না। বিশ্বকাপ কেবলই একটি ট্রফি। মাত্র সাত ম্যাচের খেলা, এর ফলাফলের ভিত্তিতেই কারো মাথায় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ওঠে চার বছরের জন্য। অথচ যাঁর পায়ে দুই দশক ধরে ফুটবল রোমাঞ্চ ছড়াচ্ছে, অবিশ্বাস্য ফুটবলের পসরায় বিনোদন দিয়ে যাচ্ছেন, তিনিই এই সাত ম্যাচের টুর্নামেন্টে বারবার শিরোপার কাছে গিয়েও ছিটকে পড়েন! এখানেই বিশ্বকাপ তাঁর জন্য এক গোলকধাঁধার টুর্নামেন্ট, নইলে তিনি মানুষের হৃদয়ের কাপ জিতে নিয়েছেন অনেক আগেই।
এটা ডিয়েগো ম্যারাডোনাও পারেননি। আর্জেন্টিনা ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জেতার পরই তাঁকে নিয়ে মেতেছে সারা বিশ্ব। আর্জেন্টিনার ফুটবল ঈশ্বর হয়েছেন, তাঁর খ্যাতির বিস্তার ঘটেছে। চার বছর বাদে আবার সেই ব্যর্থতার কান্নার ছবি গেঁথে আছে ভক্তদের হৃদয়ে। এর সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে দ্রোহ ম্যারাডোনাকে দিয়েছিল এক বিপ্লবী চরিত্র। তাঁর একদম বিপরীত চরিত্রের মানুষ লিওনেল মেসি। ক্লাসের ফার্স্ট বয় যেমন কোনো দুষ্টুমি করে না, মনোযোগী হয়ে থাকে শুধু পড়াশোনায়, তেমনি মেসিও থাকেন শুধু ফুটবল নিয়ে, তাঁর ধ্যানজ্ঞান শুধুই ফুটবল। এর বাইরে কিছুই তাঁকে যেন টানে না। ফুটবলকে ফেরি করেই কাটিয়ে দেওয়া এক জীবন, তাই গোল-রেকর্ড সবই ছুটেছে তাঁর পায়ে পায়ে। বার্সেলোনার জার্সিতে বছরের পর বছর রোমাঞ্চ ছড়িয়ে তিনি ঘরোয়া ফুটবলে আর অতৃপ্তির কিছু রাখেননি। নতুন করে কিছু পাওয়ারও হয়তো নেই। ক্লাব ফুটবলে তিনি অবিসংবাদিত রাজা। খানিকটা গরমিল আন্তর্জাতিক ফুটবলে। সাতবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী আর্জেন্টিনার জার্সিতে সদ্য জিতেছেন কোপা আমেরিকা কাপ। বিশ্বকাপ শিরোপা এখনো অধরা, বারবার এই স্বপ্নের পেছনে ছুটে ফিরেছেন খালি হাতে। এর কারণ হিসেবে ম্যারাডোনা তাঁর মধ্যে নেতৃত্বগুণের অভাব দেখেছিলেন। সেটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘মেসি দুর্দান্ত ফুটবলার, তবে সে নেতা নয়। ম্যাচের আগে যে ২০ বার বাথরুমে যায়, তার মধ্যে নেতৃত্বগুণ খুঁজে লাভ নেই। ’
ম্যারাডোনা বেঁচে থাকলে এবং এই বিশ্বকাপ দেখলে নিশ্চয়ই নতুন মেসিকে আবিষ্কার করতেন কাতারে। পুরনো মন্তব্য তুলে নিতেন। এত দিন যিনি শুধু নিজের খেলাটাই খেলেছেন এবং উপভোগ করেছেন, সেই মানুষটি এবার অন্য চেহরায়। খেলছেন, দলকে খেলাচ্ছেন, রেফারির সঙ্গে তর্ক করছেন, এমনকি প্রতিপক্ষের ডাগ-আউটে গিয়ে কোচকে শাসিয়ে আসছেন! সেই তিনি প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়কে উদ্দেশ করে বলছেন কটুকথা, ‘এই বোকা, কী খুঁজছ, বেরিয়ে যাও এখান থেকে!’ ম্যাচ শেষে নেদারল্যান্ডসের ওয়েগহোর্স্টকে বলেছিলেন এ কথা। পরে এ নিয়ে তুলকালাম হয়েছিল। অনেকে বিশ্বাসও করেনি। কারণ লিওনেল মেসিকে কখনো এভাবে দেখেনি কেউ। এ যেন ম্যারাডোনার চরিত্রে মেসি!
নিজের শেষ বিশ্বকাপটা রাঙাচ্ছেন নিজেকে বদলে ফেলে। সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার ম্যাচে খেলেছেন তিনি এই বিশ্বকাপের সেরা ম্যাচ। ৩৫ বছর বয়সী এই ম্যাজিশিয়ান ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বিকেলে ২০ বছর বয়সী ‘যোদ্ধা’ গাভারদিওলকে নাচিয়ে-কাঁদিয়ে নিজের ফুটবল যৌবনের ট্রেলার দেখিয়েছেন। এই শিক্ষা তো কখনো ভুলবেন না ক্রোয়াট ডিফেন্ডার। তার আগের ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে মলিনাকে দিয়ে করিয়েছেন অদ্ভুত সুন্দর গোল। এর পরই ম্যারাডোনার রূপ নিয়ে তিনি সওয়ার হয়েছিলেন প্রতিপক্ষ কোচের ওপর।
মেসি এবার মরিয়া, ম্যারাডোনার মতো নেতা হয়ে ‘ভালো-মন্দ’ সব কিছুই করছেন। শুধু ভালোমানুষি চেহারা আর ফুটবলের মাধুরী দিয়ে বোধ হয় বিশ্বকাপ জেতা যায় না। তার জন্য চোখও রাঙাতে হয়। মাঠ আর চোখ রাঙিয়ে আর্জেন্টিনার নেতা হয়েই ‘বিশ্বসেরা’ ফুটবলারটি এবার বিশ্বকাপ শিরোপার ম্যাচে। তাঁর হাতে কাপ তুলে দিয়েই ধন্য হতে পারে বিশ্বকাপ।