শুরুতেই বলতে হয়, ২০২২ সালকে মনে রাখতে চাইবে খুব কম লোকই। করোনা ভাইরাসের ভোগান্তির বিবেচনায় এই বছরকে সংজ্ঞায়িত করা যায় ‘মহামারির বছর’ হিসেবে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফন এবং বছর জুড়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মন্থর গতির কাছে হার মানতে বাধ্য হয় গোটা বিশ্ব! সবকিছুকে ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে জায়গা করে নেয় ইউরোপের ব্যয়বহুল যুদ্ধ! এসবের মধ্যেই দানা বাঁধতে শুরু করে নতুন উদ্বেগ—নিকট ভবিষ্যতে এশিয়ায় সহিংস সংঘাতের আশঙ্কা! এসব ইস্যুর অনেকগুলোই প্রত্যাশিত ছিল যদিও, কিন্তু ২০২২ সাল জুড়ে অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটেছে অনেক কিছুই। সবকিছু মিলিয়ে বিশ্ববাসীর সামনে এখন বড় প্রশ্ন—২০২২ আমাদের কী শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে? বস্তুত, বিদায়ি বছরে মোটা দাগে ১০টি বিষয় ছিল চোখ আটকে যাওয়ার মতো :
প্রথমত, বিভিন্ন দেশ ও শক্তির মধ্যকার যুদ্ধ লক্ষ করলাম আমরা। আমরা ইউরোপে যা দেখছি, তা পুরোনো আমলের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ ছাড়া আর কিছুই নয়। একটি সার্বভৌম, স্বাধীন সত্তা হিসেবে ইউক্রেনের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোকে থামিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পুতিন কী কারণে, কী লক্ষ্য নিয়ে ইউক্রেন আক্রমণ করে বসেন, তা আজ স্পষ্ট। একটি গণতান্ত্রিক, বাজারভিত্তিক দেশ হিসেবে ইউক্রেন পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে চায়। রাশিয়া ও পুতিনের মাথাব্যথার কারণ মূলত এটাই। রাশিয়ার কোলের মধ্যে (দেশ দুটি একই সীমান্তবর্তী তথা প্রতিবেশী) বাস করে ইউক্রেন কিছু ক্ষেত্রে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাক—এটা মানা স্বৈরশাসক পুতিনের জন্য স্বভাবতই বেশ কঠিন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এমন কোনো চোখধাঁধানো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন, যা বিশ্ব কিংবা রাশিয়ার মানুষের কাছে আকর্ষণীয়, চমক হিসেবে প্রতীয়মান হবে—এই ভয়েই ইউক্রেনকে নিঃশেষ করে দিতে এতটা মরিয়া হয়ে ওঠেন পুতিন। ঠিক এই ভয়ের কারণেই ইউক্রেনে আগ্রাসন চালান পুতিন। তবে আশ্চর্যজনকভাবে, যুদ্ধেজয়ের ক্ষেত্রে তিনি যেমনটা প্রত্যাশা করেছিলেন, ঘটেনি তেমনটা। ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার চিন্তা তথা দ্রুত ও সহজ বিজয় অর্জনের পরিবর্তে পুতিন হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছেন, তার সেনাবাহিনী ততটা শক্তিশালী নয়, যতটা এত দিন মনে করে আসছিলেন তিনি! উপরন্তু, তার প্রতিপক্ষ এতটাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, দাঁতভাঙা জবাব দিতে ছাড়েনি। ফেব্রুয়ারি মাসে যে সংঘাতের জন্ম দেন পুতিন, ১০ মাস অতিবাহিত হলেও যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণই নেই!
দ্বিতীয়ত, ২০২২ সালে এই ধারণা সর্বময় হয়েছে যে, অর্থনীতির প্রশ্নে ‘পারস্পরিক নির্ভরতা’ বর্তমান বিশ্বে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর গুরুত্ব এতটাই বেশি, অর্থনৈতিক নির্ভরতা সরাসরি যুদ্ধকে প্রভাবিত করে। এমনকি এটা যুদ্ধ-সংঘাতের বিরুদ্ধে তুলে দেয় লম্বা দেওয়াল। এর পেছনে কাজ করে মূলত পারস্পরিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কিত বিষয়গুলো। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পরিবেশ যেহেতু ব্যাহত করতে চাইবে না কোনো পক্ষই, সুতরাং যুদ্ধের নিয়ামক হয়ে ওঠে ‘অর্থনৈতিক নির্ভরতা ইস্যু’—এটাই স্বাভাবিক।
তৃতীয়ত, সমঝোতা। আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি, যেখানে সমঝোতার কোনো বালাই নেই! বিভিন্ন দেশের উত্থান-পতনের পরিপ্রেক্ষিতে সমঝোতার পথে না হেঁটে এমন সব কর্মকাণ্ড করা হচ্ছে, যাতে উত্তাপ-উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। ফলে বিভিন্ন দেশে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবস্থা এতটাই দমনমূলক হয়ে উঠেছে যে, দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, বৈদেশিক নীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তাতে কর্ণপাত করছে না শাসকগোষ্ঠী!
চতুর্থত, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। ২০২২ সালে ‘নিষেধাজ্ঞা’ টার্ম উঠে আসে আলোচনার কেন্দ্রে। বিশেষ করে পুরো বিশ্বের চেহারাই পরিবর্তন করে দেয় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সরকারগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘন বা বিদেশি আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমা বিশ্বের পছন্দের এই শব্দ হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। তবে লক্ষণীয়, নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরও আগ্রাসী রাষ্ট্র ও শক্তিগুলোর আচরণে অর্থপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হয় না। ইউক্রেনে রাশিয়ার নির্লজ্জ ও নৃশংস আগ্রাসনের জবাবে দেশটির ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় যদিও, কিন্তু কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার প্রশ্নে বিশ্বের বেশির ভাগ সরকারকে রাজি করতে হিমশিম খেতে হয়—কী অদ্ভুত কথা! পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞাগুলো রাশিয়ার অর্থনৈতিক ভিত্তিকে ক্ষয় করবে—এমন চিন্তা থেকে দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞার খড়গ চাপানো হলেও শেষ দিকে কিছু দেশ তলে তলে নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে!
পঞ্চমত, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়’—এই ধারণা এখন যেন বিলুপ্তপ্রায়! কোথাও যেন এর কার্যকারিতা চোখে পড়ে না। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার ভেটো ক্ষমতা জাতিসংঘকে পুতুলে পরিণত করেছে যেন! জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার রূপরেখা আঁকতে মিশরের শার্ম আল শেখে সম্প্রতি বিশ্বনেতারা মিলিত হলেও কার্যকর ও টেকসই ব্যবস্থা প্রণয়ন করা যায়নি। তাছাড়া কোভিড মহামারির সময়ও বিশ্বব্যাপী সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
ষষ্ঠত, গণতন্ত্র আজ স্পষ্টতই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি! কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার কোপানলে পড়ে গণতন্ত্রের সমস্যাগুলো প্রকটতর হয়ে উঠছে। কর্তৃত্ববাদী নেতাদের ব্যর্থ নীতি প্রয়োগের চিন্তার হাত ধরে বাড়ছে জন-অসন্তোষ। বাজে সব সিদ্ধান্ত ও পলিসি পরিত্যাগ করার পরিবর্তে জনগণের আন্দোলন প্রতিহত করার রাস্তা ধরছে সরকারগুলো। ক্রমাগত গণবিক্ষোভের ঝুঁকির মুখে পড়া কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা দিনে দিনে কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, তা দেখা যায় বিশেষত রাশিয়া, ইরানের দিকে তাকালেই।
সপ্তমত, গণতন্ত্রের প্রশ্নে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এমন ব্যক্তিদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য নিঃসন্দেহে এটা অনেক বড় হুমকিস্বরূপ। চীন, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মতো কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সমাজে ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ বা সীমিত করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাজকর্ম ও গতিবিধিকে নিরীক্ষণ ও সেন্সর পর্যন্ত করা হচ্ছে! অন্যদিকে, সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যা ও ভুল তথ্য প্রচার বেড়েছে, যার ফলে ‘মেরুকরণ’ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে বিশেষত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে শাসনকার্য পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
অষ্টমত, এখনো একটি ‘পশ্চিমা শক্তি’ আছে। বিভিন্ন জোটকে শৃঙ্খলায় উন্নীত করার ক্ষেত্রে এই শক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। আমরা দেখেছি, ট্রান্স আটলান্টিক অংশীদারেরা ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিক্রিয়া জানায়। চীনের পক্ষ থেকে উদ্ভূত ক্রমবর্ধমান হুমকি মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অধিকতর শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরিতে মনোনিবেশ করছে। কোয়াড (অস্ট্রেলিয়া, ভারত, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র), আকুস (অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)—এসব জোটের মাধ্যমে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করছে পশ্চিমা শক্তি। এমনকি জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা বৃদ্ধিতে মনোযোগী হচ্ছে পশ্চিমারা।
নবমত, ‘মার্কিন নেতৃত্ব’ অপরিহার্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে যতক্ষণ প্রভাব-প্রতিপত্তি ধরে রাখতে সক্ষম হবে, ততক্ষণ একতরফাভাবে আগ্রাসী কাজকর্ম করতে যে কোনো শক্তিকে দুই বার ভাবতে হবে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র যদি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, মাঠ ছেড়ে দেয় বা নিজেকে গুঁটিয়ে নেয়, তবে বিশ্ব পড়ে যাবে গভীর খাঁদে। বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্মিলিতভাবে কাজ করতে পারবে না শান্তিপ্রিয় দেশগুলো। বাস্তবিক অর্থেই, সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রশ্নে আমেরিকার বিকল্প শুধু আমেরিকাই।
সবশেষে বলতে হয়, ২০২২ সাল আমাদের এই চরম শিক্ষা দিয়েছে যে, আমাদের অবশ্যই বিনয়ী হতে হবে। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, ওপরের বিষয়গুলো নিয়ে আগের বছরগুলোতে বহু পূর্বাভাস-পূর্বানুমান ছিল। কিন্তু আমরা এগুলোর প্রতি উদাসীন ছিলাম, ছিলাম উদ্ধত। সুতরাং, আগামী দিনগুলোতে আমাদের বিনয়ী হয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে ইতিহাসের পাতা থেকে। এর থেকে ভালো বা খারাপ সময়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকতে হবে প্রতিটি দেশকে। এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই পাড়ি দিতে হবে আগামীর ২০২৩ সাল!