সাম্প্রতিক কালের ঘটনা। রাত ১২টা ৩০ মিনিট। যাত্রা শুরু হলো রাজধানীর সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে। গন্তব্য যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা। গাড়িটি চলবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে পদ্মা সেতু-ভাঙ্গার পথে। ফাঁকা মহাসড়কে কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি এক্সপ্রেসওয়েতে পৌঁছে গেল। রাস্তার দুধারে জ্বলজ্বল করা নিয়ন আলোয় স্পষ্ট পড়া গেল এই সড়কের সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। কিন্তু চালকের পেছনের ছিট থেকে উঁকি দিতেই দেখা গেল গাড়ির মিটার তখন ছুঁয়ে ফেলেছে ১০০-র কাটা! গতি ক্রমশই বাড়ছে। মুহূর্তেই পাশ থেকে আরেকটি দূরপাল্লার বাস চলে গেল অভারটেক করে। এবার ড্রাইভার সাহেব যেন আরো নড়েচড়ে বসলেন, তীব্র প্রতিযোগিতা, সামনের গাড়িটিকে অভারটেক করে ফের আগে যাওয়ার। যাত্রাপথে আরো বেশ কয়েক বার করলেন এমন ঝুঁকিপূর্ণ অভারটেক। এভাবে প্রতিনিয়তই মহাসড়কে চলছে গতির ধাওয়া-পালটা ধাওয়া!
ফকফকে দিনের আলোয় দেখা মহাসড়কগুলো যেন রাতের আঁধারে ধারণ করে ভিন্ন আরেক রূপ। স্তব্ধ গভীর রাতে যখন জনমানুষের আনাগোনা কমে যায়, গাড়ির সংখ্যাও থাকে তুলনামূলক কম, তখন চলাচলকারী আন্তঃজেলা পরিবহনগুলো আবর্তিত হয় দানবীয় গতির ভূমিকায়। সড়কের গতিসীমা লঙ্ঘন করে চলে তাদের অভারটেকের ভয়ংকর প্রতিযোগিতা। কখনো আবার চালকরা দক্ষতার মুনশিয়ানা বোঝাতে দেখান নানা কারিশমা। যেমন হেড লাইট বন্ধ রেখে বা হর্ন না বাজিয়ে করেন সামনের গাড়িকে অভারটেকের চেষ্টা। যার ফলাফল খুব ভয়ানক। সংকেত না দিয়ে এভাবে অভারটেক করতে গেলে ঘটতে পারে বড় রকমের দুর্ঘটনা। ইদানীং আবার বাস লাভার বা বাস প্রেমিক নামে একটি শব্দ বেশ পরিচিতি লাভ করছে। অনলাইন, অফলাইনে গড়ে উঠেছে এমন কিছু বাস লাভিং কমিউনিটি। এসব কমিউনিটির বাসপ্রেমিক তরুণেরা দলবদ্ধ হয়ে রাতে দূরপাল্লার বাস ভ্রমণে বের হন। বসেন চালকের পাশের সিটে। এরপর চালকদের উত্সাহিত করেন ঝুঁকিপূর্ণ অভারটেকে এবং তা ভিডিও করে ছড়িয়ে দেন সোশ্যাল মিডিয়াতে। সেসব ভিডিওতে ভিউ-ও হয় লক্ষাধিক। ফলে চালকরাও দ্বিগুণ উত্সাহে সায় দেন তাদের আবদারে, গতির ঝড় তুলে করেন ঝুঁকিপূর্ণ অভারটেকিং।
সড়কের ভৌগোলিক অবস্থান, ঝুঁকিপূর্ণতার মাত্রাসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর লক্ষ করে নির্ধারণ করা হয় সড়কের গতিসীমা। এই সীমা লঙ্ঘন করলেই নিশ্চিতভাবে পড়তে হবে ঝুঁকির মধ্যে। বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোতে সাধারণত সর্বোচ্চ গতিসীমা ধরা হয় ৮০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা, যদিও সড়কভেদে রয়েছে তার ভিন্নতা। দিনে বা রাতে এই গতিসীমা লঙ্ঘন করে অধিক গতিতে গাড়ি চালালেই বাড়বে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক মানসিকতা, পারিপার্শ্বিক চাপ বা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছাবার তাড়নায় চালকরা প্রায় সময় আশ্রয় নিচ্ছেন দ্রুত গতির। মেতে উঠছেন ভয়াবহ প্রতিযোগিতায়। যার মাশুল দিতে হয় নিরীহ যাত্রীদের!
আবার অনেক সময় দেখা যায়, অধিক লাভের আশায় চালকরা পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিয়ে, ক্লান্তি ও ঘুম চোখে রাত-দিন এক করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে ঈদ, পূজা বা বড় কোনো উৎসবের সময় এমন ঘটনা হরহামেশায় ঘটে থাকে, যা সড়ক দুর্ঘটনার একটি অন্যতম কারণ। মহাসড়কের এসব নৈরাজ্য কমিয়ে আনতে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস। একদিকে যেমন প্রচলিত ট্রাফিক আইনগুলো আরো কঠোর করা প্রয়োজন, মহাসড়কগুলোতে যানবাহনের গতি নির্ণায়ক যন্ত্র, ট্রাফিক সার্জন বর্ধিত করা প্রয়োজন; তেমনি গাড়ি মালিকদেরও উচিত আরো সচেতন হওয়া। অধিক লাভের আশায় চালকদের ওপর দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য চাপ প্রয়োগের মতো হীন কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত। পাশাপাশি গাড়িতে ভ্রমণ করা যাত্রীদেরও তাদের দ্বারা যেন চালক বা গাড়ির স্টাফগণ প্রভাবিত না হন, সেদিকে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।