প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে আখ্যায়িত করা যায় একধরনের ‘সাংস্কৃতিক আত্মহত্যা’ হিসেবে। বিশ্বের ইতিহাসে সংঘটিত এই বৃহত যুদ্ধের মধ্য দিয়েই ইউরোপের বিশিষ্টতা ধ্বংস হয়—এ কথা বলাই বাহুল্য। ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার ক্লার্কের ভাষায়, ইউরোপের নেতারা অনেকটা ঘুমের ঘোরে এমন একটি সংঘাতের রাজ্যে প্রবেশ করেন, যা ছিল অকল্পনীয়! কেউই আন্দাজ করতে পারেননি, বিশ্ব কোন মহাযুদ্ধে প্রবেশ করছে! মূলত পূর্ববর্তী দশকগুলোতে ইউরোপীয় নেতারা দুটি জোট গড়ে তোলার মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যুগে প্রবেশ করেন। তাদের কৌশলগুলো নির্ধারিত হতো নির্দিষ্ট সময়সূচিকে কেন্দ্র করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১৪ সালে বসনিয়ার সারাজেভোতে অস্ট্রিয়ান ক্রাউন প্রিন্সের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শুরু হয় একটি ‘সাধারণ যুদ্ধ’, যা পরবর্তী সময়ে পরিণত হয় বৃহত যুদ্ধে।
বর্তমান সময়ে ইউরোপের দেশগুলো প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। নিজ নিজ সামরিক বাহিনীকে ব্যাপকভাবে উন্নত করেছে দেশগুলো। একই সঙ্গে একে অপরের বিরুদ্ধে চালিয়েছে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ। ১৯১৬ সালের আগস্টে দুই বছরের যুদ্ধে (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ) লক্ষাধিক হতাহতের পর পশ্চিমের প্রধান যোদ্ধা তথা ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি হত্যাকাণ্ডের যুদ্ধের সমাপ্তির উপায় অন্বেষণ করতে শুরু করে। এর অংশ হিসেবে আমেরিকার মধ্যস্থতা চায় বিভিন্ন দেশ। প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের ব্যক্তিগত দূত কর্নেল এডওয়ার্ড হাউজের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, পরিবর্তিত স্থিতাবস্থার ওপর ভিত্তি করে শান্তির নাগাল অনেকটা সহজসাধ্যই ছিল। উইলসন শেষ পর্যন্ত মধ্যস্থতা করতে আগ্রহীও হন। তবে তিনি কিছুটা দেরি করে ফেলেন। তার এই দেরি করাই কাল হয় বিশ্বের জন্য। কারণ, তত দিনে আরও ২০ লাখ হতাহতের সংখ্যা যোগ হয় ধ্বংসযজ্ঞে। কূটনীতির পথে হাঁটার পথ রুদ্ধ হয়ে আসে। মহাযুদ্ধ আরও দুই বছর ধরে চলে। আরও লাখ লাখ প্রাণহানি ঘটে। এর ফলে ইউরোপের প্রতিষ্ঠিত ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়ে পড়ে। অপরিবর্তনীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গোটা ইউরোপ। জার্মানি ও রাশিয়ায় বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান রাষ্ট্র মানচিত্র থেকে কার্যত অদৃশ্য হয়ে যায়। ফ্রান্সে বয়ে যায় রক্তের বন্যা। তরুণ প্রজন্মের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হারায় ব্রিটেন। অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে পড়ে যুক্তরাজ্য। ভার্সাইয়ের শাস্তিমূলক চুক্তি, যা যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিল, তা অনেক বেশি ভঙ্গুর বলে প্রমাণিত হয়।
এখন দেখার বিষয়, ইউক্রেনের অবস্থা কী? চলতি শীতকালে বৃহত আকারের সামরিক অভিযানে বিরতি দেওয়ায় বিশ্ব কি আজকে ইউক্রেন যুদ্ধের তুলনামূলক মোড় ঘোরার কোনো আভাস পাচ্ছে? কোনো পরিবর্তন খুঁজে পাচ্ছে? ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ব্যর্থ করতে বারবার মিত্রবাহিনীর সামরিক প্রচেষ্টার প্রতি আমার সমর্থন প্রকাশ করেছি। সমর্থন বাড়াতে বলেছি বিভিন্ন সম্প্রদায়কেও। কিন্তু আশানুরূপ অগ্রগতি দেখা যায়নি। এখন সময় ঘনিয়ে এসেছে কৌশলগত পরিবর্তনগুলো গড়ে তুলতে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণের, যা ইতিমধ্যে কিছুটা সম্পন্নও হয়েছে। এই অবস্থায় আলোচনার মাধ্যমে শান্তি অর্জনের লক্ষ্যে একটি নতুন কাঠামো গড়ে তোলা সময়ের দাবি।
উল্লেখ করা দরকার, আধুনিক ইতিহাসে প্রথম বারের মতো মধ্য ইউরোপে প্রধানতম রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে ইউক্রেন। মিত্রদের সহায়তায় এবং প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সাহসী প্রচেষ্টায় রাশিয়ার মতো দেশকে টেক্কা দিয়ে চলেছে দেশটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপকে ধীরে ধীরে পেছনে ঠেলে দিয়ে এই অঞ্চলকে যেভাবে ‘ঝুলন্ত’ করে তোলে বৃহত শক্তি রাশিয়া, তা থেকে গোটা ইউরোপকে টেনে তুলতে আশা জাগিয়েছে ইউক্রেন। ইউক্রেনের এই চমকে দেওয়া সাফল্যে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা তো বটেই, চীনসহ বহু দেশ রাশিয়ার হুমকি ও দেশটির পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুংকারের বিরোধিতা করছে। যদিও রাশিয়া তার অবস্থানে এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ অনড়! উপরন্তু, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ক্রমাগত পারমাণবিক হুঁশিয়ারি উচ্চারণের ফলে ন্যাটোতে ইউক্রেনের সদস্যপদ পাওয়া ও না পাওয়া সম্পর্কিত আলোচনা আটকে আছে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, আমেরিকা তার মিত্রদের সহযোগিতায় ইউক্রেনে ইউরোপের বৃহত্তম ও সবচেয়ে কার্যকর স্থল সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছে। এই অবস্থায় ইউক্রেনকে ন্যাটোর সঙ্গে যুক্ত করার দ্বার উন্মোচন করতে পারে ‘একটি কার্যকর শান্তি প্রক্রিয়া’। বিশেষ করে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানের পর এই আলোচনা ওঠাই স্বাভাবিক। এ কারণে আমি বলে আসছি, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা বন্ধে যুদ্ধবিরতি আলোচনা শুরু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। যদিও এতে কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। বাস্তবতা হলো, রাশিয়া এই যুদ্ধ থেকে সরে আসবে—এরকমটা মনে হচ্ছে না। এমনকি পুতিন যদি ধ্বংসের রাস্তা থেকে সরেও আসে, তবে এক দশককাল আগে দখল করা ক্রিমিয়াসহ নতুন করে অধিকৃত অঞ্চলগুলো হাতছাড়া করতে চাইবে না—এ কথা চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়। এই যখন অবস্থা, তখন সমাধানের উপায় হবে প্রথম যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ নেওয়া এবং তারপর ক্রিমিয়া বা অন্যান্য অঞ্চল নিয়ে আলোচনা করা।
এখন প্রশ্ন হলো, রাশিয়া ও ইউক্রেনকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করানো যাবে কি না। যদি তা সম্ভব হয়, তাহলে আলোচনায় বসা যেতে পারে। আর তা যদি না হয়, তাহলে আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতির আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে। আত্মনিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে গণভোটের পথে হাঁটতে উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে সেই সব অঞ্চল নিয়ে আগে গণভোটের আলোচনা শুরু করতে হবে, যেগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী বারবার হাতবদল হয়েছে। এই শান্তি প্রক্রিয়ায় দুটি বিষয় লক্ষ্যে রাখতে হবে—প্রথমত, ইউক্রেনের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং দ্বিতীয়ত, প্রয়োজনবোধে একটি নতুন আন্তর্জাতিক কাঠামোর অবতারণা করা, বিশেষ করে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের জন্য।
অনেকেই বলছেন, যুদ্ধের মাধ্যমে ধীরে ধীরে রাশিয়াকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলার পথে হাঁটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এ ধরনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমি আদৌ একমত নই। আমার মতে, সহিংসতা কখনো সমাধানের পথ হতে পারে না। ভুলে গেলে চলবে না, অর্ধ সহস্রাব্দেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ণায়কের ভূমিকায় রয়েছে রাশিয়া। তাছাড়া দেশটির ঐতিহাসিক সক্ষমতাকে হেয় করাও হবে চরম বোকামি। আমরা দেখেছি, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক বিপর্যয় পুতিনকে কতটা খ্যাপাটে করে তুলেছে! এই যুদ্ধে রাশিয়ান সেনাদের ধরাশায়ী দৃশ্য মরিয়া করে তুলেছে পুতিনকে। এর ফলে ক্রমাগতভাবে পারমাণবিক হামলার হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছেন যুদ্ধবাজ পুতিন। এতে ইউক্রেনের যেসব অঞ্চলে বিভাজন দেখা যায়, সেই সব অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়বে স্বাভাবিকভাবেই। এই অবস্থায় ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিযোগী গোষ্ঠীগুলো সহিংসতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নিলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। এর ফলে হাজার হাজার পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত ঘটতে পারে। এমন অবস্থায় বিশ্ব এমন একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াবে, যা কল্পনারও বাইরে। সুতরাং, ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার বাইরে গিয়ে এমন কোনো ব্যবস্থার সন্ধান করতে হবে, যাতে করে বিশ্বসভ্যতা রক্ষা করা যায়।
আজকের বিশ্বে ‘দখলের মনোভাব’ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় বিশ্বের জন্য এখনো এমন কোনো জুতসই তত্ত্বের অবতারণা করা যায়নি, যার মাধ্যমে সমস্যার ইতি টানা যায়। উদ্বেগের বিষয়, এ বিষয়ে গঠন ও পরামর্শমূলক উদ্যোগ-প্রচেষ্টাও চোখে পড়ে না। এর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে মনে করা হতে পারে, অর্থপূর্ণ আলোচনা নতুন পথ দেখাবে এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য, তা হয়তো কোনো নতুন বিপদ ও ঝুঁকি ডেকে আনবে। কিন্তু এই সত্যও আমাদের মাথায় রাখতে হবে, উন্নত প্রযুক্তি ও তার নিয়ন্ত্রণ কৌশলগুলো দিনে দিনে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠছে। এ বিষয়ে আগে থেকে উদ্যোগ না নিলে আগামী দিনে তা জলবায়ু পরিবর্তনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হবে। তাই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রযুক্তির বিষয়ে ভাবতে হবে বিশ্বনেতৃত্বকে। বস্তুত, শান্তি ও শৃঙ্খলার পথ অনুসন্ধানে দুটি বিষয় মাথায় রাখার প্রয়োজন পড়ে—নিরাপত্তা উপাদানগুলোর অনুসরণ এবং পুনর্মিলনের জন্য প্রয়োজনীয়তা। যদিও তা কখনো কখনো পরস্পরবিরোধী হিসেবে বিবেচিত হয়। সর্বোপরি, আমরা যদি অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে না পারি, তবে সংঘাত বন্ধ করতে সক্ষম হব না। কূটনীতির রাস্তা জটিল যদিও, হতাশ হলে চলবে না। অগ্রগতির জন্য আমাদের প্রচেষ্টা ও যাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে। আর এজন্য সজাগ দৃষ্টি ও সাহস উভয়ই প্রয়োজন।