স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যম। তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে যুদ্ধের শুরু থেকেই বিদেশি সাংবাদিকরা পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসলীলা, নির্মম হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ ও নিপীড়নের বর্বরতার কাহিনী খুব দ্রুত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, নৃশংস বর্বরতা, ধ্বংসযজ্ঞ, শরণার্থীদের দুর্ভোগ বহির্বিশ্বের গণমাধ্যমে তুলে ধরায় বিশ্ববাসী বাঙালির ওপর হানাদার বাহিনীর বর্বরতার প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরেছিল। ২৫শে মার্চ গণহত্যার আগে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ঢাকায় অবস্থানরত প্রায় ২০০ বিদেশি সাংবাদিককে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আটকে রাখে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও যারা সেদিন কলম ধরেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং। হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষ বর্ণনা তার ডায়ারিতে লিপিবদ্ধ করেন এবং ১৯৭১ সালের ৩০শে মার্চ ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামে ডেইলি টেলিগ্রাফে প্রকাশ করে প্রথম বিশ্ববাসীর নজরে আনেন, ‘দ্য স্পেকটেটর’ ১৯৭১ সালের ১৯শে জুন এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী কয়েক সপ্তাহ ধরে পাকিস্তানে ব্যাপক হারে যে বর্বরোচিত গণহত্যা চালাচ্ছে, তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে জঘন্যতম গণহত্যা। টরন্টো টেলিগ্রাম ১৯৭১ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর এক সম্পাদকীয়তে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে ৩০ লাখ টন খাদ্য ও ভারতে ৮০ লাখ শরণার্থীর খাদ্যের ব্যবস্থা করতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা উল্লেখ করে।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক ‘সিডনি শনবার্গ’ ২৫শে মার্চের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা ছাপান নিউ ইয়র্ক টাইমসে ‘বিদ্রোহ দমাতে সৈন্যরা কামান দাগাচ্ছে’ এবং ‘পূর্ব পাকিস্তানে কামানের বিরুদ্ধে লাঠি ও বল্লম’ এই দুই শিরোনামে, কিন্তু ঢাকার অবস্থা স্বাভাবিক—এমন খবর বিশ্ববাসীকে জানানোর জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় নিয়ে আসে আট বিদেশি সাংবাদিককে। সে দলে ছিলেন অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। ১০ দিন ঢাকা শহর ঘুরে ঘুরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্বিচারে মানুষ হত্যা, যুদ্ধাপরাধের দৃশ্য ধারণ করেন তিনি। অতঃপর নিজের বিবেকের কাছে হার মেনে অসুস্থতার অজুহাতে কেটে পড়েন। ‘জেনোসাইড’ অর্থাৎ গণহত্যা শিরোনামে ১৩ই জুন লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপান। সেই রিপোর্ট পড়ে পুরো বিশ্ব কেঁপে উঠেছিল। নিউ ইয়র্ক টাইমস ১৯৭১ সালের ২৮শে মার্চ এক প্রতিবেদনে জানায়, ২৫শে মার্চ রাতে নিহত হয়েছে ১০ হাজার মানুষ। কিন্তু ১লা এপ্রিলের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার। অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকা জানিয়েছিল, শুধু ২৫শে মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক জঘন্যতম ভয়াবহ ঘটনা। পরবর্তী ৯ মাসে একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার লক্ষ্যে ৩০ লাখ নিরপরাধ মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা এক ঘৃণ্য ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে। নিউজ উইক, দ্য অবজারভার, ডেট্রয়েট ফ্রি প্রেস, ‘উইকলি নিউ এজ’সহ বিদেশি আরও অনেক পত্রিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের সংবাদ নিয়মিত প্রকাশ করেছিল।
সিঙ্গাপুরের জাতীয় পত্রিকা ‘দ্য নিউ নেশনে’ বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের হত্যাকাণ্ডের খবর তুলে ধরে এভাবে, ‘পূর্ব পাকিস্তানে নৃশংস হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতেই হবে, অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বের পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা শুনিয়ে বিশ্ববিবেকের কণ্ঠ রোধ করা যাবে না।’ বিবিসি ২৭শে মার্চ প্রচার করে, ‘পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের হুলিয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থকরা এখনো যশোর, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা নিয়ন্ত্রণ করছে।’ এরপর যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত গণমাধ্যমের প্রতিবেদকরা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ প্রকাশ করেছেন। এছাড়াও নিজেদের জীবন বাজি রেখে আরও যারা নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচার করেছিলেন, তাদের মধ্যে আছেন বিবিসির অ্যালেন গিন্সবার্গ, নিকোলাস টোমালিন, মার্টিন গুনাকাট, জন পিলজার, ডেভিড, পিটার হাজেন হার্স্ট প্রমুখ। এছাড়া যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মান, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অনেক সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশে প্রবেশ করে প্রকৃত ঘটনা বিশ্ববাসীর কাছে পত্রিকার মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের টাইম ম্যাগাজিনে নতুন বাংলাদেশ জন্মের কথা বিশ্ববাসীকে জানায় ১৯৭১ সালের ২০শে ডিসেম্বর। হাতে যুদ্ধাস্ত্র, মুখে বিজয়ের স্লোগানে এক মুক্তিযোদ্ধা বয়ান দিয়ে সেদিনের প্রতিবেদন শুরু করে এভাবে, ‘জয় বাংলা! জয় বাংলা! বিস্তীর্ণ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্রের তীর থেকে, রত্নতুল্য ধানখেতের বুক থেকে, সোনারাঙা পাহাড় আর অসংখ্য গ্রামের পর গ্রাম থেকে, আনন্দ অশ্রু থেকে উচ্চারিত হচ্ছে—বাংলার জয়! বাংলার জয়! ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের ১৬ই ডিসেম্বরের ডেটলাইনে প্রকাশিত ‘লি লেসকেজ’-এর লেখার শিরোনাম ছিল ‘পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধ শেষ :উল্লাস আর পুষ্প সংবর্ধনার মধ্য দিয়ে ভারতীয় বাহিনীর ঢাকায় প্রবেশ।’ ‘লন্ডন টাইমস’ ১৬ই ডিসেম্বর ডেটলাইনে ‘পাকিস্তানি জেনারেল উদগত কান্না চাপছিলেন’ শিরোনামে সাংবাদিক ‘পিটার ও লাওলিন’ লেখেন, ‘পশ্চাৎ থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসছিল। অস্তগামী সূর্যের আলোয় ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে পাতা টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল এক দঙ্গল মানুষ। লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি আত্মসমর্পণের দলিলে সই করছিলেন। শত শত বাঙালি জয় বাংলা ধ্বনিতে ফেটে পড়ে।’ লন্ডনের ‘ডেইলি মেইল’ পত্রিকাতে আত্মসমর্পণের ওপর প্রথম প্রতিবেদন করেন সাংবাদিক ডেনিস নিল্ড ১৬ই ডিসেম্বর। একই রকম আরও দুটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ১৭ই ডিসেম্বর নিউ ইয়র্ক টাইমসে।
অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার নীরব সাক্ষী কলকাতা প্রেসক্লাব। কলকাতার সাংবাদিকরা সে সময় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের কলমযোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন, খবর সংগ্রহ করেছেন সরাসরি রণাঙ্গন থেকে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হামলা ও হত্যাকাণ্ডের সব খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ২৬শে মার্চ কলকাতা আকাশবাণী, বিবিসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম গুরুত্ব সহকারে গণহত্যার বিবরণ প্রচার করতে থাকে। ভারতের নয়াদিল্লি থেকে ‘দি উইকলি নিউএজ’ পত্রিকা ২৬শে সেপ্টেম্বর ‘বিজয় নিশ্চিত’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। অন্য প্রদেশ থেকে প্রকাশিত পত্রিকাতেও পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা তুলে ধরে বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশ করে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করেছে। পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার, দেশ, ত্রিপুরার সংবাদ, জাগরণ, গণরাজ. রুদ্রবীণা, নাগরিক জনপদ, সাপ্তাহিক সমাচার, দেশের কথা, সীমান্ত প্রকাশ ও ত্রিপুরার কথা নামে পত্রিকাগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে সহায়তা করেছে। এভাবে বিভিন্ন দেশের খবরের কাগজে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে খবর ছাপা হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক দলিল। এগুলোর অন্তত ১ লাখ ২৪ হাজার ৮৫৬টি সংবাদ, ফিচার, চিঠি তথা কনটেন্ট সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে চলমান ‘মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভে’ সংরক্ষিত আছে। সারা বিশ্ববাসীর কাছে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা আরও সহজলভ্য করার জন্য জরিপ ও গবেষণার মাধ্যমে কালের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া তথ্য ও ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সুসংহত করার কোনো বিকল্প নেই।