কোনো সাংস্কৃতিক সমাবেশ যখন আবহমান মননের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে, যখন তার স্রোতে বহু শাখা-উপশাখার মিলিত অংশগ্রহণ তাকে কালোত্তীর্ণ করে তোলে, সে তখন তার নিঃসময়ের প্রতীকী মূর্তিকে সামনে রেখে সাড়ম্বর ইঙ্গিতে জানিয়ে দেয়, কী হওয়া দরকার আমাদের সামাজিক অবস্থান, চালিত হতে হবে কোন ভাবনাচিন্তায়? নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন, নিঃসন্দেহে এরকমই একটি ঐতিহ্যময়, সরব প্রতিষ্ঠান। দেশের ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে সে এখন বহুত্ববাদের, বঙ্গভাষী বহুদেশিদের আত্মপরিচিতি আর অঙ্গীকারের স্থায়ী মঞ্চ।
দেশভাগের মতো মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি রুখতে পারেনি তাকে, বরং ঐ সর্বগ্রাসী ভাঙনের পর সে আরও বেশি সংহত, ঐক্যবদ্ধ হয়ে তার প্রত্যয় আর প্রত্যাশাকে ক্রমাগত ছড়িয়ে দেয়। এরকম দৃষ্টান্ত কেবল এ উপমহাদেশে নয়, বিরল গোটা বিশ্বে।
অনেক ভাষাগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় বিধাতার ইচ্ছায় বিভক্ত, খণ্ডিত হয়েছে। ভারতে উর্দুভাষী, সিন্ধিভাষী, পাঞ্জাবি আর বাঙালি দেশভাগের নির্মম শিকার। এদের মধ্যে বাঙালি আর পাঞ্জাবির দুর্যোগ সর্বোচ্চ। দুই মিশ্র ভাষাগোষ্ঠীর প্রায় ৩ কোটি মানুষ পূর্বপুরুষের ভিটেবাড়ি হারিয়েছে, তাদের চিরকালের সামাজিক মিলনের ইচ্ছায় ফাটল তৈরির চেষ্টা করেছে ঔপনিবেশিকতার সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, তবু তারা থমকে যাননি, সাংস্কৃতিক দেশভাগ নস্যাত্ করে মেরুদণ্ডকে সোজা রেখেছেন, নতুন মঞ্চ গড়েছেন, পুরোনো মঞ্চে প্রাণ দিয়েছেন, সংখ্যার জোরে কিংবা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বর্ধিত ক্ষমতার ভাষার সামনে মাথা নত করেননি।
সুলতানি ও মুঘল আমলে সেনা শিবিরে গড়ে ওঠা উর্দুর নির্দিষ্ট জমি নেই। নির্দিষ্ট নৃতাত্ত্বিক ভাষাগোষ্ঠীর সমর্থন নেই তার পেছনে, অস্তিত্বের জন্য আজ তাকে প্রবল লড়াই করতে হচ্ছে। তার পরিসরে হিন্দির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এটা রাষ্ট্রের কৃত্রিম একতার সর্বগ্রাসী ইচ্ছা। দক্ষিণ, উত্তর, পশ্চিম আর পূর্ব ভারতের বহু রাজ্যে প্রবল চাপে পড়ে, উর্দুভাষীরা, কেবল পঠন-পাঠনে নয়, সমগোত্রীয় প্রতিবেশী হিন্দিকে গৃহান্তরে, হাটেবাজারে ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। এরকম প্রবণতা রুখতে যে সংগঠিত সংহতি বা আত্মশক্তির প্রয়োজন, তার উপস্থিতি অত্যন্ত দুর্বল।
‘আঞ্জুমন-এ-তরক্কি-এ উর্দু’ (উর্দু উন্নয়ন সমিতি) সর্বভারতীয় মঞ্চ হলেও নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের মতো সংগঠনের ব্যাপ্তি, সাংগঠনিক ক্ষমতা সে অর্জন করতে পারেনি। সংখ্যালঘুর হীনম্মন্যতা, সংশ্লিষ্ট সমাজের উচ্চ, মধ্য ও নিম্নবর্গের মধ্যে অবরোধ আর আত্ম অবরোধে করুণ দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে। জনপ্রিয় হিন্দি চলচ্চিত্রের গানে, সংলাপে উর্দুর প্রয়োগ যদি কখনো বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে উর্দুভাষীদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক অবদমন কর্কশ চেহারা গ্রহণ করবে। ‘আঞ্জুমান-এ-উর্দু’ এ ব্যাপারে কতটা সচেতন, জানা নেই আমাদের। ভয় হয়, কতিপয় কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, সংবাদপত্রে, ধর্মীয় সমাবেশে আর অভিজাত শ্রেণির বৈঠকখানায় উর্দু সীমাবদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। উর্দুকে তার প্রায়—অপহৃত বিচরণক্ষেত্র ফিরিয়ে দিতে হলে, বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের মতো স্থায়ী, নির্মাণশীল সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা কেবল উর্দু আকাদেমির ভরণপোষণ কিংবা সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারের চৌহদ্দিতে আটকে রাখলে উর্দুভাষার অন্তর্দাহের অবসান হবে না। চতুষ্কোণে তার উন্নয়নের জন্য ভারতীয় বহুত্বের শর্তপূরণ দরকার। এক্ষেত্রে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন কিংবা অসম সাহিত্য সভার মতো সর্বজনীন সাংগঠনিক মঞ্চ উর্দুর অভিপ্রেত ইচ্ছাপূরণের উদ্দীপক প্রেরণা হতে পারে।
উর্দু বাঙালির মাতৃভাষা নয়। ধাত্রীভাষাও হতে পারেনি। সুলতানি আর মুঘল আমলে তার নিঃশব্দ অভিযান বাংলার সীমান্তে এসে থমকে যায়। গ্রহণশীল ভাষা হয়েও বাংলা তার ভেতরে বাইরে উর্দুর আগ্রাসনকে আমল দেয়নি। পেশোয়ার থেকে দিল্লি হয়ে লখনৌ-পাটনা, কাশ্মীর থেকে দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত উর্দুর যে সৃজনশীল ও লৌকিক প্রভাববলয় তৈরি হয়েছিল, বাংলায় সেরকম পরিসর ও পরিবেশ নির্মিত হয়নি। সমবেত শক্তির দৌলতেই বাংলা ভাষা তার স্বনিয়ন্ত্রিত মানচিত্র সৃষ্টি করেছে। চট্টগ্রাম-আরাকান থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কাছারি রাজ্য পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ডে একসময় ভাষিক সংস্কৃতির জোরেই বাংলা ও বাঙালি অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। অপরাজেয় ঝোঁক, সমগোত্রীয়তা আর মিশ্র শক্তির অংশগ্রহণে সে কেবল এই উপমহাদেশের নয়, নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতির যোগাযোগ ও মননশীলতার ভাষা। অঙ্গীকার তার নির্দিষ্ট জাতিগঠনের। চীনের মান্দারিন ছাড়া বিশ্বের অন্য কোনো জাতিগোষ্ঠীর এরকম সৌভাগ্য সম্ভবত বিরল। বাঙালিই নিজের সাংস্কৃতিক ভাগ্যের স্রষ্টা সে, বিশ্বমানবের উপাসকও সে, তার উপাসনায় যুক্ত হয়েছে অখণ্ডের অবিভাজ্য, নির্মাণমুখর পরিধি আর তেজোদীপ্ত ভাষাগোষ্ঠীর কালহীন অঙ্গীকার। এটা একধরনের আত্মোপলব্ধির শক্তিমান, সুবিস্তৃত অভিজ্ঞান। এর একটি সামাজিক আর রাজনৈতিক সংজ্ঞা আছে, যা বাঙালি জাতিসত্তার স্বপ্নের ধারাবাহিক নির্মাণের সঙ্গে পুরোপুরি সংযুক্ত। বাঙালি বহিরঙ্গে খানিকটা রুগ্ন হতে পারে। ভাঙনের পর ভাঙনে অপকৌশলে কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা এবং তার ভাষা আর সংস্কৃতিকে অবরোধের চত্বরে ঠেলে দিয়ে অপবাদ আর অপমানের সামনে দাঁড় করানোর যতই ষড়যন্ত্র হোক না কেন, তাকে চির উদ্বাস্তু বা স্বদেশে, বিদেশেও মানসিক পরবাসী করে তোলা অসম্ভব। শতবর্ষব্যাপী নিখিল বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের জেগে থাকা, টিকে থাকা, অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালিয়ে যাওয়া তার স্থিতিস্থাপকতারই অপরিহার্য উদাহরণ।
আজ বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা আর অসমে বাঙালি আর বাংলাভাষা আগ্রাসনের সম্মুখীন। বাংলার পঠনপাঠন কমছে। বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গোটা বঙ্গীয় সমতটে পরিস্থিতি দুঃখজনক। অসতর্কতা বড় বেশি পীড়াদায়ক। হিন্দি ও ইংরাজি নিয়ে আমাদের ঔপনিবেশিক খোঁয়াড়েপনা এখনো অব্যাহত। এতে বাঙালির রুগ্নতাবোধ জটিল চেহারা ধারণ করতে পারে। সচেতন প্রতিরোধ দরকার। দরকার বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের মতো অবারিত মঞ্চের গঠনশীল হস্তক্ষেপ।
উনিশ শতকে, নবজাগরণের উন্মেষ পর্বে বাংলা ভাষা ও বঙ্গ সংস্কৃতির চর্চা ও উন্নয়নে যেসব সংগঠন ছিল, তা যথার্থ সম্প্রদায় নিরপেক্ষ ছিল না। তাদের অন্যান্য সীমাবদ্ধতাও ছিল। বিংশ শতকের গোড়াতে, উত্তর ভারতে পেশাদার, চিকিৎসক, আইনজীবী ও উচ্চপদস্থ চাকরিজীবীদের উদ্যোগে, সবধরনের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে যে সম্মেলন কানপুরে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে, তার প্রভাব সর্বভারতীয় হয়ে উঠতে পারেনি। তবু মূল সংগঠক, সুপরিচিত চিকিৎসক সুরেন্দ্রনাথ সেনের নিষ্ঠা আর সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিপাতকে অবজ্ঞা করা অন্যায়। তিনিই প্রথম বাংলার বাইরে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের প্রচারমঞ্চ নির্মাণ করে বঙ্গ সমাজের বার্ষিক যে উৎসবের সূচনা করেছিলেন, তা বিবর্তিত চেহারায় কালক্রমে প্রায় সর্বভারতীয় হয়ে ওঠে। লখনৌতে দ্বিতীয় সম্মেলনে যোগ দিলেন অতুলপ্রসাদ সেন, রাধাকমল মুখোপাধ্যায়, শ্রীশচন্দ্রের মতো মহাজনেরা। ১৯২২ সালে অতুল প্রসাদ সেনের সভাপতিত্বে তৈরি হয় উত্তর ভারতের বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন।
প্রথম অধিবেশন কাশীতে। সাফল্য বিস্ময়কর। সামাজিক আর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উত্তেজনার আঁচ। গান্ধীজির নেতৃত্বে জাতীয় কংগ্রেস উজ্জীবিত। ব্রিটিশবিরোধী চাপ বাড়ছে। মুক্তিকামী বিপ্লবীরা ক্রমশ শক্তি বাড়াচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ রাজনীতির সঙ্গে যথাসম্ভব দূরত্ব তৈরি করে সামাজিক কর্মকাণ্ডকে বাড়িয়ে তুলতে ব্যস্ত। তার প্রধান মনোনিবেশ নির্মীয়মাণ বিশ্বভারতীর ভাবাবেগের বিস্তারে আর সাহিত্যিক ভাবনাচিন্তায়।
এরকম পরিস্থিতিতে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বার্ষিক সাহিত্য সমাজের সংযোগ ঘটল। তার সভাপতিত্বে পরিচালিত হলো উত্তর ভারতীয় সাহিত্য সম্মেলনের কাশী অধিবেশন। ঐ বছরেই, সংগঠনের রূপান্তর ঘটল। ১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে বিবর্তিত নাম হলো প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন। ৩০ বছর পর, ১৯৫৩ সালে আবার নাম বদল, ‘নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’। ১৯২২ সালকে গোড়াপত্তনের ভিত্তিবর্ষ গণ্য করলে (করা উচিত) বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের বয়স ১০০। এবার সে ১০১-এ পা দেবে। সাহিত্য বিষয়ক সংগঠনের ইতিহাসের এ এক অনুপম ঘটনা। বাঙালির প্রতিস্পর্ধা, বাঙালির পুঞ্জীভূত অভিমান, বাঙালির সৃজনের সমূহ তাড়না, তার প্রাণশক্তি, তার ঘ্রাণশক্তি, তার গানের মহিমা, কবিতা ও গদ্যশিল্পের সম্পদ সাজিয়ে বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের শতবর্ষ উদযাপন, আর তিন দিনব্যাপী তার সমাপ্তি অনুষ্ঠানকে ইতিহাস মনে রাখবে। অপরিসীম এর প্রাসঙ্গিকতা।
বাঙালি যখন ঘরেবাইরে আক্রান্ত, যখন বিভাজনের রাজনীতি তার গঠনশীল সামাজিকতা, রুচি আর দৃষ্টিকে দিকভ্রান্ত করে তুলতে মরিয়া; যখন কুকথা, অপবাদ তির্যক হয়ে উঠছে; যখন কোলাহলে মুখরিত আত্মঘাতী প্রবণতা হামলে পড়ছে, যখন কিছু কিছু অপলাপ জাতিকে বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যখন কবন্ধেরা ধেয়ে আসছে জাতির ভাবাবেগকে গ্রাস করবে বলে, এরকম মুহূর্তে ধারাবাহিক ঐতিহ্যের আনুপূর্বিক উত্থাপন আর উদযাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ উদযাপনের বিস্তার নিছক আনুষ্ঠানিক নয়। আনুষ্ঠানিকতার বাইরেও সে এক অপরিহার্য অবলম্বন। নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন এদিক থেকে নিঃসময়ের ঋদ্ধ, অক্লান্ত প্রতিনিধি। ভাগ্য তার সুলিখিত। শতবর্ষ জুড়ে যারা এ মঞ্চের পরিচিত কাণ্ডারি ছিলেন, এখনো যারা সক্রিয়, সবাই চিত্তবলে বলীয়মান। সাংগঠনিক দৌলত, আত্মশক্তি আর প্রাণচাঞ্চল্যের তারা বিত্তশালী। এ পর্যন্ত যে যে শহরে বঙ্গ সম্মেলনের আয়োজন হয়েছে, এগিয়ে এসেছে যেসব প্রতিষ্ঠান, তাদের ঐকান্তিক নিষ্ঠায় একাত্মতার যোগ প্রশ্নাতীত। বলতে ভালো লাগছে, শতবর্ষের সমাপ্তি অনুষ্ঠান হবে কলকাতার সিস্টার নিবেদিতার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে, ২৫ থেকে ২৭ ডিসেম্বর। বাচিক শিল্পী আর আচার্য সত্যম রায় চৌধুরীর তদারকিতে। আসন্ন সমারোহ, আশা করি, বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের আরেক দিকদর্শী মাইলফলক হয়ে থাকবে।