চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে হারানোর পর আল খলিফা স্টেডিয়ামে নিজেদের ড্রেসিংরুমে বাঁধভাঙা উদ্যিপনা করেছে জাপান জাতীয় ফুটবল দল। এমন জয়ের পর আনন্দ-উল্লাস মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তাই বলে নিজেদের দায়িত্বটা ভুলে যায়নি হাজিমে মোরিয়াসুর দল। ড্রেসিংরুমে এতটুকু ময়লা থাকলেও সেটি পরিষ্কার করে তারপর হোটেলে ফেরার বাস ধরেছে।
যে কোনো কিছুতে প্রথম হওয়া, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মধ্যে একটা আলাদা গর্ব বা কৃতিত্ব আছে। বিশ্বকাপ ফুটবলের কথাই ধরা যাক। বিশ্বকাপ ফুটবলে যে দল চ্যাম্পিয়ন হয়, তাদের কী গর্ব আর অহংকার! এবার যেমন আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হয়ে অহংকারের ফানুস উড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আমরা খেলাধুলায় ভালো করতে না পারলেও সমর্থক হিসেবে আমাদের কোনো জুড়ি নেই। এ ব্যাপারে আমরা অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। আমাদের দেশে বিশ্বকাপ ফুটবল উত্তেজনায়, ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে এক মাসে অন্তত ১৫ জনের মৃত্যু ঘটেছে। পৃথিবীর আর কোথাও এমন ঘটনা ঘটেনি, অন্য কোনো দেশে এমন কিছু কল্পনাও করা যায় না। তবে শুধু ফুটবল খেলার সমর্থক হিসেবেই নয়, আমাদের দেশ আরো নানা ক্ষেত্রে অদ্বিতীয়, চ্যাম্পিয়ন। দুর্নীতিতে আমাদের সমকক্ষ দেশ খুব কম আছে। এ ব্যাপারে আমরা ব্রাজিলের ফুটবল শিরোপার চেয়েও বেশি বার চ্যাম্পিয়ন খেতাব জিতেছি। দুই নম্বরি, বেশি কথা বলা কম কাজ করা, অন্যের পেছনে লাগা, প্যাঁচ কষা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও আমাদের চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে, এমন দেশ খুব কম আছে। এবার আমরা নতুন করে আবারও একটি খেতাব জয় করেছি। বিশ্বের শীর্ষ ঘনবসতিপূর্ণ মহানগরী ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়ও শীর্ষ স্থান দখল করেছে। গত ১৪ ডিসেম্বর সকাল ১০টা ১০ মিনিটে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ঢাকার (একিউআই) স্কোর ছিল ৩৮২।
সাধারণত ১০০ থেকে ২০০-এর মধ্যে একিউআই সংবেদনশীল মানুষের জন্য অস্বাস্থ্যকর বলে বিবেচিত হয়। একইভাবে একিউআই ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে থাকলে সংশ্লিষ্ট শহরের পরিবেশ বসবাসের জন্য খারাপ এবং ৩০১ থেকে ৪০০-এর মধ্যে থাকলে বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচিত হয়। বাতাসের মান নির্ণয়ের জন্য একিউআই একটি সূচক। সরকারি সংস্থাগুলো একটি নির্দিষ্ট শহরের বায়ু কতটা পরিষ্কার বা দূষিত ও এজন্য মানবস্বাস্থ্যে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে বা তা উদ্বেগের কারণ হতে পারে কি না তা জানতে সূচকটি ব্যবহার করে থাকে।
বাংলাদেশের সামগ্রিক একিউআই পাঁচটি দূষণকারী মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে নির্ণয় করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে কণা পদার্থ (পিএম১০ এবং পিএম২.৫), কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাইঅক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড ও ওজোন।
ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে বায়ুদূষণে ভুগছে। এর বাতাসের গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায় এবং বর্ষাকালে কিছুটা উন্নত হয়। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উত্স হলো ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলো।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন দূষিত বাতাসে শ্বাস নেন এবং বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর প্রধানত নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশে আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু ঘটে।
আসলে শুধু বায়ুদূষণ নয়, পরিবেশ দূষণ বা চারপাশের পরিবেশকে নোংরা করা, শব্দদূষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও আমরা তুলনাহীন। তবে আমাদের ব্যর্থতা যে, আমরা এ ব্যাপারে পৃথিবীর অন্য সব দেশকে খুব একটা শিক্ষা দিতে পারিনি। আমাদের আদর্শ তেমন কেউ গ্রহণ করেনি।
আমাদের সবচেয়ে বেশি ‘অপমান’ করছে যে দেশটি, তার নাম হলো জাপান। এই দেশটি আমাদের নীতি-আদর্শ-জাতীয় ঐতিহ্যবিরোধী বিভিন্ন কাজকর্ম করছে। এমনকি বিশ্বকাপ ফুটবল খেলতে এসেও সে দেশের দর্শকরা আমাদের ‘আদর্শবিরোধী’ নানা কাণ্ড করেছে।
রাশিয়া বিশ্বকাপের পর কাতার বিশ্বকাপেও তারা ‘অমল’ ফুটবল খেলেছে। অমল মানে হচ্ছে মল বা ময়লা নেই এমন—নির্মল, অনাবিল, পরিষ্কার, কালিমামুক্ত। সুন্দর, সাদা, পরিচ্ছন্ন, খাঁটি। হলুদ কার্ড নয়, লাল কার্ড তো নয়ই। সুন্দর আর পরিচ্ছন্ন খেলা ছাড়া জাপানের যেন আর কোনো ব্রত নেই। বিশ্ব জোড়া হননক্রীড়ার ময়দানেও সেটা মানবতার এক অভিনব পাঠ। আত্মরক্ষা, কিন্তু আঘাত নয়। খেলা, কিন্তু অনৈতিকতা নয়। অমলতাই শেষ আশ্রয়। অন্তিম অবলম্বন। এই মন্ত্রেও যে এগোনো যায়, এই মন্ত্রেই যে এগোনো উচিত, সেই শিক্ষা, সেই মহাশিক্ষকতা সম্পন্ন করলেন জেন-কাব্যের দেশ, উদিত সূর্যের দেশের ফুটবল দল।
কাতার বিশ্বকাপে জাপানের সাফল্যকে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। ইউরোপীয়দের মতো উচ্চতা ও শক্তি নেই, লাতিন আমেরিকার সূক্ষ্ম শিল্পকলা নেই, কিন্তু সবই যেন কিছু কিছু আছে। সবকিছু মিলিয়েই বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রায় প্রথম স্তরে জাপান। আগামী দিনে দেশটি ফুটবলে নতুন সূর্যোদয় ঘটালে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
সেই সঙ্গে জাপানিরা যেন প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেলেন : জীবনযুদ্ধের পাঠ্যক্রম থেকে ‘অল ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার’ বা ‘দ্য রুলস অব ফেয়ার প্লে ডু নট অ্যাপ্লাই ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার’ আপ্তবাক্য বিসর্জন দেওয়ার সময় কী হলো? বিশ্বরাজনীতির পাঠ্যক্রম প্রণেতারা, ভূগোলক নিয়ে নিরন্তর রক্তাক্ত বন্দুকক্রীড়ায় মত্ত বিরাট শিশুরা একবার ভেবে দেখবেন কি?
পুনশ্চ : বিশ্বফুটবলে আমাদের দেশের অবস্থান প্রায় তলানিতে। কিন্তু সমর্থনের দিক থেকে আমরা সবার শীর্ষে। আমাদের ফুটবল সমর্থকরা নিয়ত নোংরামি, ঝগড়া, কলহ, বিদ্বেষ ছড়িয়ে আনন্দ প্রকাশ করে। আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ফুটবল সমর্থকদের কদর্য কাদা ছোড়াছুড়িতে পুরোপুরি নিমজ্জিত।
ওদিকে জাপানের ফুটবল দলের মতো জাপানি ফুটবল সমর্থকরাও অনন্য অসাধারণ আচরণ প্রদর্শন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিশ্বকাপের যে কোনো ম্যাচ শেষ হওয়ার পর গ্যালারির আসনসহ পুরো স্টেডিয়াম সাধারণত ভর্তি হয়ে পরে মানুষের ফেলে যাওয়া খাবার, গ্লাস, কাপ, বোতল, ব্যানার, ফেস্টুন ও কাগজের জিনিসপত্রে। খেলা পরবর্তী এসব আবর্জনা খুব দ্রুত পরিষ্কারের জন্য রয়েছে শত শত পরিচ্ছন্নতা কর্মী। কিন্তু জাপানিরা এসবের ধার ধারে না। খেলা দেখতে আসার সময়ই তারা সঙ্গে করে নিয়ে আসে পলিথিনের বিশাল ব্যাগ। খেলার ফলাফল যাই হোক, দল হারুক কিংবা জিতুক। স্টেডিয়ামের সকল ময়লা-আবর্জনা তারা বস্তাবন্দি করে রাখে। তাদের বক্তব্য হলো, স্টেডিয়ামে প্রবেশ করে যে অবস্থায় এটাকে পেয়েছি, ঠিক সেই অবস্থায় এটিকে আমরা রেখে যেতে চাই! গত কয়েক বছর ধরেই খেলা দেখতে আসা জাপানি সমর্থকরা এই কাজটি করছেন।
এবারও জার্মানিকে ২-১ গোলের ব্যবধানে হারানোর পর তারা উল্লাস করতে গিয়ে গ্যালারিতে ফেলে যাওয়া নিজেদের আবর্জনা পরিষ্কার করতে একদমই ভুলে যাননি। সবাই যখন আবর্জনা ফেলে স্টেডিয়াম থেকে বের হয় প্রিয় দলের জয়ে উল্লাস করতে করতে, জাপান সমর্থকরা তখন ব্যস্ত স্টেডিয়াম পরিষ্কারের কাজে।
চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে হারানোর পর আল খলিফা স্টেডিয়ামে নিজেদের ড্রেসিংরুমে বাঁধভাঙা উদ্যাপন করেছে জাপান জাতীয় ফুটবল দল। এমন জয়ের পর আনন্দ-উল্লাস মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তাই বলে নিজেদের দায়িত্বটা ভুলে যায়নি হাজিমে মোরিয়াসুর দল। ড্রেসিংরুমে এতটুকু ময়লা থাকলেও সেটি পরিষ্কার করে তারপর হোটেলে ফেরার বাস ধরেছে। অনুশীলনে যেসব জার্সি পরেছেন জাপানের খেলোয়াড়েরা, সেসব জার্সি সুন্দর ভাঁজ করে রাখা হয়েছে ড্রেসিংরুমের ভেতরে রাখা টেবিলের পাশে। তার পাশেই অব্যবহূত পানির বোতলের স্তূপ গুছিয়ে রেখেছে।
জার্মানির বিপক্ষে ম্যাচে বেঁচে যাওয়া খাবারগুলো টেবিলের ওপর সুন্দর সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রেখেছে। তার পেছনেই ‘অরিগামি’ কাগজ ভাঁজ করে বানানো হাঁসের প্রতিকৃতি। অরিগামি জাপানের সংস্কৃতির অংশ। ধন্যবাদ জানানোর অংশ হিসেবেই অরিগামি করে একটি হাঁস এবং আরো দু-একটি খুদে প্রতিকৃতি রেখে যান জাপানের খেলোয়াড়েরা। এখানেই শেষ নয়। আরবি ও জাপানিজ ভাষায় ধন্যবাদ জ্ঞাপনসূচক একটি চিরকুটও টেবিলে রেখে গেছে এশিয়ার দলটি।
জাপানের ফুটবল দল যেমন ভালো খেলার জন্য হাততালি পাচ্ছে, তেমন হাততালি ও প্রশংসা কুড়াচ্ছে জাপানের সমর্থকরাও। তারা যেন ফুটবল সমর্থনেও একটা নতুন ধারা যোগ করেছেন।
ফুটবল ম্যাচের পর স্টেডিয়াম পরিষ্কার করা জাপানিদের স্কুলে শেখা মৌলিক আচরণেরই একটি শিক্ষার বহিঃপ্রকাশ। শৈশবেই জাপানিরা তাদের স্কুলের শ্রেণিকক্ষ ও আবাসিক হলগুলো নিজেরাই পরিষ্কার করে।
অথচ আমরা যেন তার বিপরীত। আমরা ভিন্ন মতাবলম্বীকে কবজি কেটে, মেরে, পিটিয়ে হাত-পায়ের হাড় গুঁড়ো করে দিতে চাই। ভিন্ন দলের সমর্থকদের গালাগাল, অপমান করি, কদর্য আক্রমণে ফেসবুক ভরে ফেলি। সবাই যেন অলিখিত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, আমাদের শহর ও পরিবেশ কে কার থেকে বেশি নোংরা করতে পারি, আরেক জনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কে কার থেকে বেশি নোংরামি করতে পারি! আমাদের শহর ময়লা, রাজনীতি ময়লা, মনও ময়লা! আমরা বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে মাতোয়ারা হব, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে হইহই আর হায় হায় করব; কিন্তু কিছুই কি শিখব না?