আমার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তিনটি বই ‘মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে মম’ ‘Bangladesh Wins Freedom’ (ইংরেজি), ‘বাংলাদেশ উইনস ফ্রিডম’ (বাংলায়)-এ মুক্তিযুদ্ধের কিছু স্মৃতি প্রকাশ করেছি। ব্যতিক্রম শুধু খুলনার খালিশপুরের একটি গভীর বেদনাদীর্ণ একটি মর্মস্পর্শী ঘটনা!
খুলনার খালিশপুরের উক্ত মর্মস্পর্শী ঘটনার কথা আমি আমার বইতে লিখতে পারিনি বা কোনো পত্র-পত্রিকায় লিখে আজও প্রকাশ করতে পারিনি। ইত্তেফাকের জন্য এই প্রথম স্মৃতিচারণে বিষয়টি উল্লেখ না করে পারলাম না। খুলনায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল, ঢাকায় জেনারেল নিয়াজির নেতৃত্বে পাকিস্তানি জেনারেলদের আত্মসমর্পণের এক দিন পর। কারণ, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা ও যশোরে অবস্থিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে খুলনায় সমবেত হতে থাকে। এমনকি, যশোর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড প্রায় বিনা যুদ্ধে যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে দিয়ে খুলনায় পৌঁছে তারা চার/পাঁচটি জেলার মোট প্রায় ২৫ হাজার ফোর্স খুলনার রূপসা নদী দিয়ে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত আমেরিকার সপ্তম নৌ-বহরের সাহায্যে পাকিস্তানে পালিয়ে যাবার গোপন পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিল যশোর ক্যান্টনমেন্টের ডিভ কমান্ডার ১০৭ ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ খান।
১৭ ডিসেম্বর শুক্রবার খুলনার আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমি তার সাক্ষাৎ গ্রহণ করি ও তার ব্যর্থতার কথা সে স্বীকার করে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীকে মোকাবিলার জন্য তাদের সাত/আটটি ট্যাংক বহরের দ্বারা যশোরের শিরমণিতে তারা দুর্ভেদ্য ডিফেন্স গড়ে তোলে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তানি সেনাদের হেড কোয়ার্টারের পতন হয়ে গেলেও খুলনায় তারা এক দিন বেশি প্রতিরোধ করে রাখতে সমর্থ হয়। ১৭ ডিসেম্বর দুপুরে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর হাতে তাদের নির্মম পরাজয় ঘটে ও খুলনা সার্কিট হাউজ ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতা উইলিয়াম ফোর্ট থেকে আসা ব্রিগেডিয়ার দেলবার সিংয়ের সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপনডেন্ট হিসেবে আমি উক্ত আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান কভার করি। ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ খান তার দলবলসহ ব্রিগেডিয়ার দেলবার সিংয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
উক্ত আত্মসমর্পণ শেষে আমাকে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, খালিশপুর জুট মিলের পেছনে দুই-এক দিন আগে বহু বাঙালি ভাইবোনকে নিয়ে পাকিস্তানি সেনারা ও তাদের দেশীয় দালাল রাজাকার-আলবদররা হত্যা করে। শোনামাত্র এক জনের মোটরসাইকেলে করে সেখানে আমি ছুটে যাই। খালিশপুরে জুট মিল এলাকায় যখন পৌঁছে যাই, তখন সেখানকার নন-বাঙালিরা আমাকে সেদিকে যেতে বাধা দেয়। আমি তাদের বলি যে, আমি বিবিসিতে সংবাদ দেব। সে কথা সত্য, কারণ আমার বহু সংবাদ বিবিসিতে মার্ক টালির মাধ্যমে ৯ মাস ধরে আমার বাই নেমে প্রচারিত হয়েছে। আমি বিবিসির কথা বলায় নন-বাঙালিরা আমাকে যেতে দেয়। সেখানে গিয়ে আমি এক জুট মিলের পেছনে খোলা মাঠে নারিকেলগাছের পাতা দিয়ে ঢাকা বহু বাঙালি ভাইবোনের মৃতদেহ দেখি। ৯ মাস ধরে বহু রণাঙ্গনে এ ধরনের মৃতদেহ দেখতে দেখতে আমার মধ্যে কোনো ভয়ভীতির লেশমাত্র তখন ছিল না।
প্রায় ১০/১১টি মৃতদেহ পার হয়ে যাবার পর হঠাৎ আমার বাঁদিকে চোখ থমকে গেল এক জন কিশোরী নগ্ন বোনের ওপর। চোখ থমকে যাওয়ার কারণ হলো, তার বুকের ওপর একটি বাঁশের লাঠি পোঁতা ছিল। যার মাথায় পাকিস্তানি পতাকা দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল এবং আরেকটি বাঁশের লাঠি আমার সেই মমতাময়ী বোনের নিম্নাঙ্গে পোঁতা ছিল। আমাদের সেই শহিদ বোনের মুখের দিকে তাকালাম। তার বড় বড় মায়া ভরা আঁখি দুটি আকাশের দিকে তাকানো ছিল। টুকটুকে ফর্সা আমাদের সেই বোনের মুখ সম্পূর্ণ নীল হয়ে ছিল। আকাশের দিকে তার বড় বড় আয়ত আঁখি দুটি মেলে ধরা ছিল। বঙ্গ-জননীর আদরের নিষ্পাপ সেই কিশোরীর আঁখি দুটি আকাশের দিকে মেলে ধরে আল্লাহকে কী বলছিল? আল্লাহর কাছে কী ফরিয়াদ করছিল? সেখানে দাঁড়িয়ে সে কথা মনে করে আমার চোখ দিয়ে দর দর করে পানি পড়ছিল। সেখানে আমার মোটরসাইকেল চালকের ও আমার শার্ট খুলে আমরা আদরে, সম্মানে আমাদের বোনের নগ্ন শরীর ঢেকে দিয়ে আসি এবং বাঁশের লাঠি দুটি উপড়ে ফেলি। এমন অসীম মর্মস্পর্শী ও বেদনাদীর্ণ দৃশ্য আমি ৯ মাসের রণাঙ্গনে দ্বিতীয়টি আর দেখিনি। ৯ মাস ধরে বাংলাদেশের হাজার হাজার গ্রাম জুড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এমন হাজার হাজার, লাখ লাখ মর্মস্পর্শী, বেদনাদীর্ণ মর্মান্তিক ঘটনার জন্ম দিয়েছে।
স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে সপ্তাহে দুই বার ‘রণাঙ্গন ঘুরে এলাম’ ও ‘মুক্তাঞ্চল ঘুরে এলাম’ শিরোনামে স্বকণ্ঠে প্রচারিত নিয়মিত দুটি কথিকা আমি প্রচার করতাম। যেখানে আমি বিভিন্ন রণাঙ্গনে বাঙালি বীর যোদ্ধাদের ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বীরত্ব গাঁথা ও আত্মদানের গৌরবময় ঘটনা তুলে ধরতাম। তাদের পরিবারের সদস্যদের যুদ্ধে প্রেরণের আহ্বান জানাতাম। যুদ্ধকালীন আমি বহু মুক্তাঞ্চলে গিয়েছি, যেখানকার পিতা-মাতারা আমাকে বলেছেন যে, স্বাধীন বাংলা বেতারে আমার আহ্বান তারা শুনেছেন এবং তাদের সন্তানদের রণাঙ্গনে পাঠাতে তারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
তবে নির্মোহচিত্তে ও নির্ভীক প্রাণে বলতে পারি, ৩০ লাখ শহিদের স্বপ্ন এখনো অপূর্ণ রয়ে গেছে। সাড়ে ৬ লাখ বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্ন অধরা রয়ে গেছে। পাঁচ লক্ষাধিক বীরঙ্গনা বোনের দীর্ঘশ্বাস চুয়ান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ বয়ে বেড়াচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নপূরণে আমাদের আরো কাজ করতে হবে। বাঙালির অজ্ঞতা ও অনৈক্য দূর করে এবং অর্থনৈতিক সাম্যতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই জাতিকে পৃথিবীর অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।