২০২১ সালে আমি বলেছিলাম, ইউরোপের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে ইউক্রেন যুদ্ধের চূড়ান্ত মীমাংসার ফলাফলের ভিত্তিতে। বছর শেষে হিসাব কষে দেখা যাচ্ছে, আমার সেই কথা বাস্তব হয়ে প্রতিঘাত করছে। আমার সেই সাহসী বিবৃতি এখন স্বীকৃত সত্য। ইউক্রেন ইউরোপের ঢাল হয়ে উঠেছে—চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের ঘাত-প্রতিঘাতে আজকের দিনের বাস্তবতা এটাই। ইউরোপের সঙ্গে ইউক্রেনের যে ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, তার সুরক্ষা নিশ্চিত করাই এখন ইউরোপের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ইউরোপ মহাদেশকে রক্ষার প্রশ্নে বিষয়টি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। ইউক্রেন যুদ্ধের আগামী দিনের বাস্তবতা হলো, কেবল ইউক্রেনীয় বাহিনীর সফলতায় একটি করে নতুন পালক যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) চলার পথ সহজতর হয়ে উঠতে পারে। রাশিয়ার পতনই কেবল ইউরোপের জন্য মহাশঙ্কা হয়ে ওঠা হুমকিকে হ্রাস করতে পারে।
বিগত ১০ মাসে ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। পশ্চিমা বিশ্বকে আক্রমণ করে ধরাশায়ী করার চিন্তায় কয়েক দশক ধরে প্রশিক্ষণ নেওয়া বিপুলসংখ্যক রাশিয়ান সেনা ইউনিট ধ্বংস করেছে ইউক্রেনের সেনারা। রাশিয়ান বাহিনীকে ইউক্রেনের সেনারা এমনভাবে গুঁড়িয়ে দিয়েছে যে, রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা পুনরুদ্ধার করতে লেগে যাবে বছরের পর বছর। ইউক্রেনের বাহিনী বীরত্ব প্রদর্শন করেছে যদিও, তথাপি ইউরোপের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কৌশল ঢেলে সাজানো সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এই প্রক্রিয়া শুরুর আগে অবশ্যই বিশেষ করে বিগত বারো মাসের ঘটনাগুলোকে আমলে নেওয়া জরুরি। মূলত ঘটে যাওয়া নানা ঘটনাকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তবেই পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে যাওয়া উচিত। আমরা দেখেছি, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে লাখ লাখ শরণার্থী কতটা বেকায়দায় পড়েছে। বৈশ্বিক জ্বালানি নিয়ে বিশ্ব কতটা হিমশিম অবস্থায় পড়েছে তা-ও অজানা নয় কারো। এসবের ফলে বৈশ্বিক খাদ্যসংকট কতটা প্রকটতর হয়ে ওঠে, তাও হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের মানুষ। পূর্ণ মাত্রায় রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হলে বিশ্ব যে চরম বেকায়দা পড়বে, বিশ্বব্যাপী যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে, তা সারা বিশ্বের জন্য একটি চরম শিক্ষা হয়ে উঠবে। নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইন নিয়ে যে কাণ্ড ঘটে এবং এর ফলে বিশ্ববাসী যে করুণ পরিণতি বরণ করতে বাধ্য হয়, তা আসলেই আমলে নেওয়ার বিষয়। এ ধরনের ঘটনা থেকে শিক্ষা না নিলে সামনের দিনে বিশ্বের জন্য যে কী কঠিন বিপদ আসবে, তা ভাবলেও শিহরিত হতে হয়!
নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইন একটি সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক প্রকল্প। এটাকেই টার্গেট করে বসেন যুদ্ধবাজ পুতিন। আজ এটা প্রমাণিত, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ‘স্বাভাবিক’ লেনদেন তথা রাশিয়ার সঙ্গে কোনো ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। বাস্তবিক অর্থে, দেশটির সঙ্গে ইউরোপের ব্যবসা করার স্বাভাবিক পরিবেশ থাকবে বলেও মনে হয় না। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেয় বটে, তাতে আশানুরূপ কাজ হয়েছে বলে দ্বিমত থাকতে পারে। অন্যদিকে ইউক্রেনকে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা প্রদান করেছে পশ্চিমা বিশ্ব, যা যুদ্ধের গতিপথ নির্ধারণে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তবে আসল ঘটনা অন্যখানে। আক্রমণ শুরুর আগেই কেন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি? এ নিয়ে তখন কথা বলা হলেও তা পাত্তা পায়নি। এমনকি একে ‘অসম্ভব’ বলেও মনে করা হয়। এই উপেক্ষা বড় চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে পরবর্তী সময়গুলোতে। পশ্চিমা বিশ্বের জন্যই শুধু নয়, বিপদ আছড়ে পড়ে রাশিয়ার নিজের মাটিতেও। পরবর্তীকালে মস্কো বিভিন্ন সন্ত্রাসী-আগ্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে অপরাধমূলক জোট গঠনের চেষ্টা করেছে, যা নিতান্তই অনাকাঙ্ক্ষিত। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধে ইরানের ভূমিকা হতবাক করেছে সবাইকে। ইরানের ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইউক্রেনের বেসামরিক জনগণ ও স্থাপনা যেভাবে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়, তা ছিল অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ঘটনা। এই প্রযুক্তিসহ অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্র নিকট ভবিষ্যতে অন্য কোথাও মোতায়েন করা হলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। এর ফলে আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা যে ক্রমাগতভাবে হুমকির মুখে পড়বে তা বলাই বাহুল্য।
রাশিয়া ও ইরান উভয়কেই এর আগে বহু বার অত্যন্ত উদার শর্তে বৈশ্বিক একীকরণের নীতি অনুসরণ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে দেশগুলো কোনো ধরনের কর্ণপাত তো করেইনি, বরং এর পরিবর্তে সজ্ঞানেই বেছে নিয়েছে সংঘর্ষের রাস্তা। জ্বালানি ও খাদ্য সরবরাহ থেকে শুরু করে অভিবাসী ও সোশ্যাল মিডিয়া—সবকিছুকে অস্ত্রে পরিণত করার চেষ্টা করতে ছাড়েনি। এই প্রচেষ্টা এটা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যে, পশ্চিমা নেতারা কঠোর অবস্থান গ্রহণ না করলে সামনের দিনে কী ঘটতে পারে! দেশগুলোর এই অপতত্পরতা সত্যিকার অর্থে সেই ইঙ্গিতই দেয়। সত্যি বলতে, আজকে যে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি চলছে, নিরাপত্তা পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটেছে, রাশিয়াকে যদি চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা না যায়, তবে তার জন্য বিশাল মাশুল গুনতে হবে ২০২৩ সালে। ভূরাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দেওয়ার ফল যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, বিশ্ব ইতিমধ্যেই তা টের পেয়েছে মর্মে মর্মে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এতটা বাজে অবস্থা দেখেনি ইউরোপ। হাজার হাজার প্রাণহানি ও ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে গোটা ইউরাপের নিরাপত্তার স্কেল। ইতিমধ্যে কোটি কোটি ডলার আর্থিক মাশুল গুনতে হয়েছে। সুতরাং আগামী দিনে ইউরোপের নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষার ফল কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
যা হোক, নিরাপত্তার সংকট মোকাবিলার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ইউরোপের উচিত হবে যত দ্রুত সম্ভব কাজ শুরু করা। উদ্যোগ গ্রহণ করা। রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখানোর পরিবর্তে কঠোর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার কোনো বিকল্প নেই। যুদ্ধপূর্ব স্থিতাবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে এছাড়া সহজ উপায় আছে বলে অন্তত আমার জানা নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, পশ্চিমা নেতাদের অবশ্যই দ্ব্যর্থহীনভাবে রাশিয়ার পরাজয়কে একটি অর্জনযোগ্য ও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। আসন্ন ২০২৩ সাল সামনে রেখে পশ্চিমা বিশ্বকে ঠান্ডা মাথায় করণীয় নির্ধারণে মনোনিবেশ করতে হবে। তা না হলে ২০২২ সালের মতো একই ধরনের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে ইউক্রেন, ইউরোপসহ সারা বিশ্ব। ভুলে গেলে চলবে না, ২৪ ফেব্রুয়ারি যখন ইউক্রেনে পুতিন বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়, তখন হতবাক হয়ে গিয়েছিল পুরো বিশ্ব। শুরুতে বুঝে ওঠা যাচ্ছিল না, কী ধরনের ব্যবস্থা নিলে তা কাজে আসবে। কিন্তু সময় তো অনেক গড়িয়েছে। যুদ্ধের দীর্ঘ গতিপথ দেখেছি আমরা। সুতরাং আজকের অবস্থায় দাঁড়িয়ে কোনো ধরনের অজুহাত আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়।
রাশিয়া বর্তমানে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার জন্য মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামোতে মুহুর্মুহু বোমা হামলা করছে আগ্রাসী রাশিয়ান বাহিনী। এই যখন অবস্থা, তখন ইউক্রেনকে আলোচনার টেবিলে বসানোর চিন্তা করা নিতান্তই বাতুলতা। পুতিন বাহিনী নির্বিচার গোলাবর্ষণ করে ইউক্রেন জুড়ে যে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, তাতে করে পুতিনের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা চলতে পারে না। অনেকেই কূটনীতির কথা বলছেন, সমঝোতা-শান্তির কথা বলছেন—এসব শুধু কালক্ষেপণই করবে। এর মধ্য দিয়ে শুধু যুদ্ধ দীর্ঘায়িতই হবে। এর মধ্য দিয়ে কেবল নতুন আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের মঞ্চই তৈরি হবে। কাজেই তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারাটাই এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। ইউক্রেনের অংশীদারদের অবশ্যই এ ধরনের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করতে হবে। রাশিয়ার পরাজয় ছাড়া ‘শান্তি অসম্ভব’—এটাই এখন বাস্তবতা।
মূলত পশ্চিমা নীতিনির্ধারকদের এখন রাশিয়ার দুর্বলতাকে পুঁজি করে ব্যবস্থা গ্রহণের চিন্তা করা উচিত। এর অংশ হিসেবে ইউক্রেনকে বিমান প্রতিরক্ষা, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, ট্যাংক ও যুদ্ধের সমাপ্তি টানার জন্য প্রয়োজনীয় বিমানব্যবস্থা সরবরাহ করা উচিত। ইউক্রেনের আন্তর্জাতিক অংশীদারদের পক্ষ থেকে এগুলো সরবরাহে যতই কালক্ষেপণ করা হবে, ক্রেমলিনকে আগ্রাসন চালিয়ে যেতে তা উত্সাহিত করতেই থাকবে।
২০২২ সালে ইউক্রেন প্রমাণ করে দিয়েছে, পশ্চিমাদের সরবরাহ করা অস্ত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম ইউক্রেনীয় বাহিনী। রাশিয়াও এটা বুঝতে পেরেছে ভালোমতোই। এজন্য এখন নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে রাশিয়ান বাহিনী। নতুন করে আক্রমণ শানানোর চিন্তা করছেন পুতিন। এই অবস্থায় কোনো ‘অবান্তর-ভুল ভয়ের চিন্তা’ থেকে পশ্চিমা নেতারা যদি রাশিয়াকে থামাতে পদক্ষেপ নিতে গড়িমসি করেন, তবে তা সবার জন্য ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনবে না। তাই সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। মোট কথা, পশ্চিমাদের অবশ্যই বিগত বছর থেকে শিক্ষা নিয়ে সিদ্ধান্তমূলক পথ ধরে হাঁটতে হবে। মাথায় রাখতে হবে, বিশ্ব ২০২৩ সালে প্রবেশ করতে চলেছে। রাশিয়ার পরাজয় নিশ্চিত করতে না পারলে বিদায়ি বছরের কঠিন পরিস্থিতিই নতুন বছরে সঙ্গী হবে বিশ্বের। সুতরাং, ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হতে হবে রাশিয়াকে পরাস্ত করা, পুতিনকে ধরাশায়ী করা।