বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক সংগঠন। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বৃহত্তর সংগঠন হিসেবে এর পরিচিতি সারা পৃথিবীতে। গত ২৪শে ডিসেম্বর সংগঠনটির ২২তম জাতীয় সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছে সফলভাবে। সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দলটির নানা ইতিহাস বাঙালির হৃদয়কে আন্দোলিত করে আসছে সব সময়। রাজনৈতিক ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে এ সংগঠনটির ঢেউ আছড়ে পড়া দেখেছে পৃথিবীর মানুষ।
১৯৪৯ সালে ২৩ জুন ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেন প্যালেস থেকে যাত্রা শুরু করে আজ অবধি অবিচল গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ ও মানুষের কল্যাণে গণতান্ত্রিক চেতনাকে সমুন্নত রেখে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই আওয়ামী লীগ পথ অতিক্রম করে আজ এক মহিরুহ সংগঠনে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক সংগঠনের এমন উদ্দীপনাময় উৎসবমুখর সম্মেলন বিরল। দিন যত গড়াবে আওয়ামী লীগ রাজনীতির ইতিহাসকে করবে আরো সমৃদ্ধ ও মজবুত। বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার জায়গায় আওয়ামী লীগের অবস্থান সুদৃঢ় এবং পরিপক্ব। আওয়ামী লীগের জন্ম ইতিহাস ব্যাপক এবং বিস্তৃত। স্বল্পপরিসরে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তাছাড়া আওয়ামী লীগের ইতিহাস কমবেশি সব মানুষই জানে।
আওয়ামী লীগ মানেই স্বাধীনতার ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, একটা জাতির আত্মবিকাশ ও আত্মমর্যাদার ইতিহাস। যে লক্ষ্য নিয়ে এই সংগঠনটির জন্ম হয়েছে তার প্রতিটি লক্ষ্যই বাস্তবতার নিরিখে সফলতার চূড়ান্ত বিবেচনায় উত্তীর্ণ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ব্রিটিশরাজের কাছ থেকে তৎকালীন ভারতবর্ষ মুক্তি লাভ করে তিন খণ্ডে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। এ দুটো রাষ্ট্রের একটি পাকিস্তান, অন্যটি ভারত। পাকিস্তানের একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান যেটি আজকের বাংলাদেশ। স্বাধীন ও মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার প্রত্যাশায় ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হলেও পাকিস্তানে বাঙালি জাতি শোষণের হাতিয়ারে পরিণত হয়। সীমাহীন বৈষম্যের কবলে নিমজ্জিত বাঙালি জাতিকে উদ্ধারের নিমিত্তে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পরবর্তী সময়ে ১৯৫৫ সালে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হয়। চিরায়ত বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সমুন্নত রাখতেই আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। তরুণ শেখ মুজিব হন যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক। শেখ মুজিবের অসীম সাহস, মেধা ও যোগ্যতা অন্যান্য সবার সামনে ফুটে উঠলে ১৯৫২ সালে প্রথমে আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন।
পরবর্তী সময়ে আরমানিটোলার মুকুল প্রেক্ষাগৃহের সম্মেলনের মাধ্যমে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। টানা ১৩ বছর সফলতার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে সংগঠনকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুয়ারে নিয়ে যান। ১৯৬৬ সালের ১লা মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। উল্লেখ্য, ১৯৫৭ সালে পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে মতভেদের কারণে দলে ভাঙন দেখা দেয়। এ বছর ৭ ও ৮ই ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারী সম্মেলনে দলে বিভক্তি স্পষ্ট হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ। পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে তরুণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হন। এ যেন এক নতুন আওয়ামী লীগ। নতুন করে যাত্রা শুরু করে।
১৯৬৬ সাল ছিল ঘটনাবহুল একটি বছর। বাঙালির দাসত্ব শেখ মুজিবকে দারুণভাবে বিপ্লবী করে তোলে। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত হয় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মহাসম্মেলন। আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব করেন শেখ মুজিবুর রহমান। সম্মেলনে তিনি পূর্ব-পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছয় দফা দাবি পেশ করেন। এর মূল উদ্দেশ্য পাকিস্তান হবে একটি যৌথ রাষ্ট্র এবং ছয় দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে এই যৌথ রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করা। শেখ মুজিব জানতেন, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তার প্রস্তাব মেনে নেবে না। ছয় দফার পেছনে যে উদ্দেশ্য, সেটি হলো বাঙালি জাতির স্বাধীনতার আন্দোলনকে বেগবান করা। ছয় দফার সমর্থনে প্রথম চট্টগ্রামে ঐতিহ্যবাহী লালদীঘির ময়দানে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন বৃহত্তর চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুরের ঘনিষ্ঠ সহচর শার্দুল জননেতা শেখ মুজিবের ছয় দফা জনতার উদ্দেশ্যে পাঠ করে শোনান। ছয় দফা না মানলে এক দফা স্বাধীনতা আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া হয়। বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলন সাগরের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়তে থাকে সবার দুয়ারে দুয়ারে। বাঙালি জেগে ওঠে। ১৯৬৯ সালে স্বৈরাচারী জেনারেল আইয়ুব শাহির পতন ঘটে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। ২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ শেখ মুজিবকে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তৎকালীন ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে বক্তৃতা করেন। শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির দূত হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করলে পাকিস্তানি সামরিক শাসনের ভিত কেঁপে ওঠে। এর আগে আন্দোলনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা ছয় দফার সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করে।
মূলত ছয় দফা ও ১১ দফা স্বাধীনতা আন্দোলনের অনুষঙ্গ হিসেবে জনতার দাবিতে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগ বাঙালির প্রাণের সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের হৃদপিণ্ড বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বহুবার কারাবরণ করতে হয়। জীবনের বেশির ভাগ সময়ই তাকে কারাভোগ করতে হয়েছে। তার পরও তিনি কখনো মাথা নত করেননি। কোনো লোভলালসার কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। তারই সফল নেতৃত্বে একটি জাতি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। আমরা জানি কোনো বিপ্লব, তা ধর্মীয় সামাজিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে সংগঠিত হয় সমকালীন অবস্থার প্রেক্ষাপটে এক বা একাধিক শক্তিশালী নেতার নেতৃত্বে। আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর মতো একজন শক্তিশালী নেতার নেতৃত্বে। ইতিহাসে এ সাক্ষ্য জন্ম-জন্মান্তরে বহন করবে।
যে দলটির নেতৃত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধু একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে ইতিহাস তৈরি করেছেন সেই দলটিই বারবার বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয়েছে। স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে তারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের গুণে। ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়। আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ভয়ানক অপচেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। কারণ আওয়ামী লীগের শেকড় অনেক গভীরে। রাজনৈতিক নানা ঘটনাপরম্পরায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলটি শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছতে সক্ষম হয়। জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ই মে দলটির সভাপতির দায়িত্ব্ব গ্রহণ করে বিস্ময়কর ইতিহাসের জন্ম দিয়েছেন। তার নেতৃত্বেই বঙ্গবন্ধু পরবর্তী চার দফা আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এনেছেন। শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব ও বিচক্ষণতা দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছে। তিনি বিশ্বাসকে সুরক্ষিত করেছেন। রাজনৈতিক দলের বিশ্বাসকে যদি সুরক্ষিত না করা যায়, তাহলে সব রীতিনীতি ভেঙে পড়ে। যা বর্তমানে অন্যান্য রাজনৈতিক দলে ঘটছে।
ইডেন গার্ডেনে যে দলটি আত্মপ্রকাশ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মপ্রকাশের মহিমাকে মহিমান্বিত করেছে ২২তম সম্মেলনে। তাৎপর্যপূর্ণ এই সম্মেলনে সমগ্র নেতাকর্মীকে উজ্জীবিত করেছে আগামী দিনের প্রত্যাশায়। দেশ ও জাতিকে রক্ষার মহান দায়িত্ব আগামীর দিনে আওয়ামী লীগকেই গ্রহণ করতে হবে সে বার্তাটি পৌঁছে গেছে সবার ঘরে ঘরে। ক্ষমতায় ফিরে আসুক বা না আসুক তবু জাতির ভাগ্যোন্নয়নে আওয়ামী লীগ থাকবে অবিচল। আওয়ামী লীগ একটি বৃহৎ বৃক্ষের ন্যায় মহিরুহসদৃশ। স্বাভাবিক কারণেই এর শাখা-প্রশাখা অনেক। শাখা-প্রশাখার সঙ্গে মূল বৃক্ষের সম্পর্ক ওতপ্রোত। মূল থেকেই শাখা-প্রশাখা পরিপুষ্ট হয়ে থাকে। এর কোনো অঙ্গকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা যায় না। তাই এই সংগঠনের সমস্ত নেতাকর্মী নির্ভীক।
আগামীর লক্ষ্য হচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ। ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তর অঙ্গীকারে দল এগিয়ে যাবে। দেশে যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয় তা জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের গুণে। তার আধুনিক দর্শন সেবা ও ত্যাগই দেশকে দেশের মানুষকে অনন্যউচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। তার অমিত দর্শনই আমাদের পাথেয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন। তিনি পুনরায় সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে সমগ্র নেতাকর্মী ও দেশের মানুষের কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছেন।