অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে বৈশ্বিক কারণে। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাজারে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত এই বাজেট প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, ব্যবসায়ী ও স্বল্প আয়ের লোকসহ সব শ্রেণির মানুষের জন্য সহায়ক হবে।
বিজ্ঞাপন
আমরা এমনভাবেই এই বাজেট প্রণয়ন করেছি। ’
গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী ছাড়াও বক্তব্য দেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জাহিদ মালেক, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার, এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মোহাম্মদ রহমাতুল মুনিম প্রমুখ।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমি গরিব ছিলাম। গরিব হওয়ার কষ্ট হাড়ে হাড়ে বুঝি। তাই বাজার নিয়ন্ত্রণে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যে পরিমাণ চাহিদা আছে, সে পরিমাণ পণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এক বছরে বিশ্বে পণ্যমূল্য বেড়েছে ৩০ শতাংশ। তার প্রভাবে আংশিক হলেও দাম বাড়বে। ’
তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি আরো গতিশীল করা হবে। এই বাজেট প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দরিদ্রতা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। বাজেটে দরিদ্র শ্রেণির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রশ্নের উত্তর দেন অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে খাদ্যশস্য উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বাজেটে। কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। বিপিসি প্রতিদিন ৬৫ কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে। ইউরিয়া সারের কেজিতে ৮৪ টাকা ভর্তুকি দিয়ে ১৬ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দের মধ্যে সঞ্চয়পত্রের সুদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অর্থ সরাসরি উপকারভোগীদের হাতে পৌঁছানো হচ্ছে। আরো ১০০ উপজেলাকে এই কর্মসূচিতে যুক্ত করা হবে। ’
অর্থসচিব বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট বরাদ্দ চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় যথেষ্ট। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলে অর্থের সংস্থান করা চ্যালেঞ্জ হবে। ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর বিষয়ে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে ব্যাংকগুলোর অলস তারল্যপ্রবাহ হবে। আমানতের জন্য ব্যাংকগুলোকে সুদ দিচ্ছে। সরকার যদি টাকা নেয় তাহলে ব্যাংকগুলোর দুই লাখ ছয় হাজার কোটি টাকা বাজারে ছাড়তে হবে।
কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, চিকন চালের দাম বেড়ে প্রতি কেজি ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মোটা চালের দাম বাড়েনি। দেশের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ মোটা চাল খায়। খাদ্যশস্য উৎপাদনে ২৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি পরিশোধ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা মানুষের ভাতের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করছি। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। …খাদ্য নিয়ে হাহাকার নাই। ’
প্রসঙ্গ টাকা পাচার
বাজেটে বিদেশে থাকা সম্পদের ‘দায়মুক্তি’ দিয়ে তা দেশে আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ফলে ১৫ থেকে ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিদেশে থাকা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি দেশে নিয়ে এলে তা বৈধ বলে গণ্য করা হবে। ওই আয়ের উৎস নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবে না সরকার।
তবে বিদেশে টাকা পাচার হয়েছে বলে বিশ্বাস করেন না অর্থমন্ত্রী। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যাঁরা নিয়ে গেছেন তাঁরা বুঝতেই পারেননি। না বুঝেই নিয়ে গেছেন। তাই তো হোয়াইট (বৈধ) করার জন্য সেগুলোকে আমাদের অর্থনীতির মূলধারায় নিয়ে আসার জন্যে বাজেটে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘যেটা পাচার হয়ে গেছে সেটা এ দেশের মানুষের হক। যদি বাধা দিই, তবে আসবে না। যদি না আসে আমাদের লাভটা কী? আমরা চাই, অন্য দেশ যা করে, আমরা তাই করতে যাচ্ছি। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, মালয়েশিয়া, নরওয়েসহ ১৭টি দেশ অ্যামনেস্টি দিয়ে টাকা ফেরত আনছে। ২০১৬ সালে অ্যামনেস্টি দিয়ে ইন্দোনেশিয়া ৯.৬ বিলিয়ন ডলার ফেরত এনেছিল। ’ তিনি বলেন, ‘টাকার একটা ধর্ম আছে বা বৈশিষ্ট্য আছে। যেখানে রিটার্ন বেশি সেখানে চলে যায়। টাকা যারা পাচার করে সুটকেসে করে পাচার করে না। এখন ডিজিটাল যুগ। বিভিন্ন ভাবে পাচার করে। কখনো কখনো বিভিন্ন কারণে টাকা চলে যায়। আমি টাকা পাচার হয় না কখনো বলি না। প্রমাণ ছাড়া বললে মামলায় আসে না। এই মুহূর্তে দেশের ভেতর যারা এসব কাজ করে, তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কোর্টে মামলা আছে। ’
যাঁরা টাকা ফেরত আনবেন, তাঁরা সুরক্ষা পাবেন কি না এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য অর্থমন্ত্রী এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমকে বলেন। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, যাঁরা টাকা ফেরত আনবেন, তাঁরা সংসদের মাধ্যমে আইন দ্বারা সুরক্ষিত হবেন। ফলে তাঁদের সুরক্ষা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। ট্রুথ কমিশনের সঙ্গে এই আইনের কোনো সম্পর্ক নেই।
দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে। সরকারি সংস্থাগুলো কী করছে—এমন প্রশ্নের জবাব দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। তিনি বলেন, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের যত অর্থ আছে, তার ৯৫ শতাংশই বাংলাদেশ থেকে যায়নি। বিশ্বের অন্যান্য দেশে জমাকৃত অর্থ বাংলাদেশিরা সুইস ব্যাংকে জমা করেছেন।
পি কে হালদার এবং পাচারকৃত টাকা দুটিই ফেরত আসবে
পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে পি কে হালদারের ব্যাপারে সাংবাদিকরা অর্থমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন।
হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠার পর বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি কে হালদার। গত ১৪ মে তিনি ভারতে গ্রেপ্তার হন। সেখানেও তাঁর অবৈধ সম্পদের খোঁজ মেলার খবর আসছে গণমাধ্যমে।
পি কে হালদারের কথা মনে করিয়ে দিয়ে মুস্তফা কামাল বলেন, ‘ভারত সরকারের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তাঁর টাকা ভারত থেকে ফেরত আসবে। তাঁকেও ফেরত আনা হবে। ’