বাংলাদেশের স্বাধীনতার পাঁচ দশকে আমরা অনেক কিছু অর্জন করিয়াছি। বিশেষ করিয়া গত এক দশকেও আমরা যাহা লাভ করিয়াছি, তাহাকে খাটো করিয়া দেখিবার অবকাশ নাই। আমরা উড়াল সড়ক হইতে শুরু করিয়া বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, পদ্মা সেতু, উন্নত ঘরবাড়ি, গাড়ি, সড়ক-মহাসড়ক, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ কত কী অর্জন করিয়াছি। বঙ্গবন্ধু টানেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ আরো কত কী লাভ করিব। আজ আমরা মেট্রোরেলের যুগেও পদার্পণ করিতেছি। নিঃসন্দেহে এই সব অর্জনের গুরুত্ব সমধিক। কিন্তু স্বাধীনতার পর আমরা কী বিসর্জন দিয়াছি বা হারাইয়াছি, তাহা কি একবার ভাবিয়া দেখিয়াছি? শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ক্রীড়াসহ অনেক কিছুতেই আমাদের উন্নয়ন হইয়াছে, কিন্তু রাজনৈতিক উন্নয়নে আমরা কত দূর অগ্রসর হইয়াছি? বিশেষ করিয়া পরাধীন আমলেও আমাদের যে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিরাজমান ছিল, তাহার আজ কতটা অবশিষ্ট রহিয়াছে?
পরাধীন পাকিস্তান আমলেও লৌহমানব ও স্বৈরশাসক আইয়ুব খান গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে হাউজ অ্যারেস্ট করিয়াছিলেন, তাহাকে রাজবন্দির মর্যাদা দিয়াছিলেন। ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত ভারতে যখন আইন অমান্যের আন্দোলন শুরু হইয়াছিল, তখন মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরুসহ ১৫ হাজার রাজবন্দি ছিলেন। নিশ্চয়ই তাহাদের দাগি আসামিদের সঙ্গে জেল খাটিতে হয় নাই। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে আজ ‘রাজবন্দি’ কথাটার কি কোনো অস্তিত্ব আছে? রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে যেইভাবে যৌক্তিক-অযৌক্তিক মামলা দেওয়া হইতেছে, রাস্তাঘাট ও বাড়ি হইতে তুলিয়া নেওয়া হইতেছে এবং জেলে চোর-ডাকাত, সন্ত্রাসী ও দাগি আসামির সঙ্গে রাখা হইতেছে, তাহা কি কাহারো কাম্য হইতে পারে? তাহাদের ডিভিশন লইয়াও বিভিন্ন সরকারের আমল হইতে চলিয়া আসিতেছে ইঁদুর-বিড়াল খেলা। অথচ আইয়ুব খানের আমলে তাহার বিরুদ্ধে আন্দোলনের কারণে আমাদের রাজনীতিবিদদের অনেকে জেলে গিয়াছিলেন ঠিকই, তবে জেলখানায় তাহাদের একটি কার্ড দেওয়া হইত। সেইখানে স্পষ্ট করিয়াই লেখা থাকিত ‘রাজবন্দি’। সেই কার্ড দিয়া তাহারা সব রকম সুযোগ-সুবিধা লাভ করিতেন। এখন মন্ত্রী এবং সাবেক মন্ত্রীও জেলে গেলে এমন মর্যাদা বা সুযোগ-সুবিধা কতখানি লাভ করেন? আমরা স্বাধীনতার পর অনেক কিছু অর্জন করিলেও কী হারাইয়াছি তাহা কি আর বলিবার অপেক্ষা রাখে?
বাংলা একাডেমির অভিধানে বলা হইয়াছে, রাজবন্দি অর্থ হইল রাজনৈতিক কারণে কারাগারে আটক ব্যক্তি। ইংরাজিতে বলা হয় স্টেট প্রিজনার। ইহার আরেক অর্থ—ভিন্নমতাবলম্বী হিসাবে কারারুদ্ধ ব্যক্তি। সরকারবিরোধিতা বা রাষ্ট্রদ্রোহের কারণে আটক রাজনৈতিক নেতা বা কর্মী। গণতান্ত্রিক দেশে ভিন্ন মত, পথ, দর্শন ও দল যে কাহারো থাকিতে পারে। কিন্তু রাজনীতিবিদদের চরিত্র হননের জন্য যেইভাবে তাহাদের চোর, মাদকসেবী, সন্ত্রাসী বা জঙ্গি বানানো হইতেছে, তাহা দুঃখজনক। মাহাথির মোহাম্মদের বিরোধিতা করায় একসময়ের সহকর্মী আনোয়ার ইব্রাহিমের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংসে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ মালয়েশিয়ায় তাহার বিরুদ্ধে আনা হইয়াছিল সমকামিতার অভিযোগ। অথচ আজ তিনিই দেশটির প্রধানমন্ত্রী এবং মাহাথির মোহাম্মদ আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক হইয়াও এইবারের নির্বাচনে হারাইয়াছেন জামানত। আমাদের দেশে সব সরকারের আমলেই কম আর বেশি রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে যেই সকল উদ্দেশ্যমূলক, গায়েবি ও মিথ্যা মামলা দেওয়ার অপসংস্কৃতি চলিয়া আসিতেছে, সেইখানে আজ ফুলস্টপ দেওয়ার সময় আসিয়াছে। অর্থ চুরি বা আয়-ব্যয়ের সঙ্গে হিসাবের সামঞ্জস্য না থাকাসহ এমন সকল অভিযোগে গ্রেফতার করা হইতেছে, যাহা হাস্যকর। বাসার পেইন্টিং, ময়না পাখি, পোষা কুকুর ইত্যাদির মূল্য ধরিয়াও আয়-ব্যয় হিসাব করিবার নজির রহিয়াছে। আবার দেশে গৃহবন্দি নাই—এমন কথাও আমরা বলিতে পারি না। তবে যখন বলা হয়, বেশি কথা বলিলে আবার জেলে পুরিব, তখন বলা যাইতে পারে, বাসায় রাখাটা যেন নির্ভর করিতেছে কাহারও অনুকম্পা বা কৃপার উপর।
পরাধীন ব্রিটিশ আমলে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রাজবন্দি ছিলেন। তাহার প্রবন্ধ ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’র চাইতেও ছোটগল্প ‘রাজবন্দির চিঠি’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে এক জায়গায় কবিতা আকারে তিনি লিখিয়াছেন, ‘অপমান কেনা শুধু! প্রাণ দিলে পায়ে দলে যাবে তোর প্রাণ!/ শুধু অনাদর, শুধু অবহেলা, শুধু অপমান!’ যেইখানে আমাদের রাজনীতিবিদদের রাজবন্দিরই মর্যাদা নাই, সেইখানে তাহারা কতটা অপমানিত ও অপদস্থ হইতেছেন, তাহা কি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব?