পদ্মাসেতুর পর এবার বাঙালি জাতির আরো একটি অবিশ্বাস্য স্বপ্নপূরণ হলো। খুলল দ্বিতীয় স্বপ্নের দ্বার। যানজটের নগরী ঢাকায় বহুলকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের মেট্রোরেলের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরমধ্য দিয়ে গণপরিবহনের নতুন যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। যাতায়াতের কষ্ট লাঘব হবে রাজধানীবাসীর। সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসংবলিত এই মেট্রোরেল গণপরিবহনে অনন্য মাইলফলক। বৈদ্যুতিক ট্রেন হওয়ায় এটি পরিবেশের ক্ষতি করবে না। পাশাপাশি মেট্রোরেলের কারণে ঢাকায় জ্বালানিচালিত গাড়ির ব্যবহারও কমবে। জ্বালানির ব্যবহার কমলে পরিবেশ উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
প্রায় ২ কোটি মানুষের বাস ঢাকা, মেট্রোপলিটান নগরী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে একটি অভাব প্রকট হয়ে উঠেছিল, সেই অভাব ঘুচল অবশেষে, বাংলাদেশের রাজধানীতে গড়াল মেট্রোরেলের চাকা। প্রধানমন্ত্রী গতকাল বুধবার বেলা ১১টা ৫ মিনিটে উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের সি-১ ব্লকের খেলার মাঠে ফলক উন্মোচনের মধ্য দিয়ে দেশের প্রথম মেট্রোরেলের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটারের ফলক উন্মোচন করা হয়। এতে বছরে বাঁচবে ৪ লাখ কর্মঘণ্টা। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠকন্যা ও প্রধানমন্ত্রীর বোন শেখ রেহানা উপস্থিত ছিলেন। পরে সেখানে উদ্বোধন উপলক্ষ্যে আয়োজিত সুধী সমাবেশ শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মেট্রোরেলের ছবিসংবলিত স্মারক ডাকটিকিট, ৫০ টাকার স্মারক নোট, খাম এবং ডাটা কার্ড অবমুক্ত করেন। এরপর ফিতা কেটে মেট্রোরেলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
বেলা ১টা ৩৩ মিনিটে দিয়াবাড়ী স্টেশনের ১ নম্বর টিকিট কাউন্টার থেকে মূল্য পরিশোধ করে টিকিট (কার্ড) কাটেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন শেখ রেহানা। তিনিও টিকিট (কার্ড) কাটেন। ১টা ৩৭ মিনিটে কার্ড পাঞ্চ করেন প্রধানমন্ত্রী ও তার ছোট বোন। চলন্ত সিঁড়িতে চড়ে প্ল্যাটফর্মে যান তারা। পরে সবুজ রঙের পতাকা নেড়ে মেট্রো ট্রেন চলাচলের সবুজ সংকেত দেন তিনি । তারপর সেই পতাকায় স্বাক্ষরও করেন প্রধানমন্ত্রী। বেলা ১টা ৪৫ মিনিটে ট্রেনে প্রবেশ করেন প্রধানমন্ত্রী। মেট্রোরেলে প্রধানমন্ত্রী ও তার বোন শেখ রেহানার মাঝের আসনে বসেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী। যাত্রাপথে আসন থেকে উঠে অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী। বেলা ১টা ৫৩ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী ও তার সফর সঙ্গীদের বহনকারী ট্রেনটি আগারগাঁওয়ের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। আর আগারগাঁও পৌঁছায় দুপুর ২টা ১১ মিনিটে। ধীর গতিতে চলে ১৮ মিনিটে গন্তব্যে পৌঁছায় প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী দেশের প্রথম মেট্রোরেল। আগারগাঁও স্টেশনে পৌঁছানোর পর মেট্রোরেল থেকে হাসিমুখে নেমে আসেন প্রধানমন্ত্রী ও অন্য যাত্রীরা। প্রধানমন্ত্রী নেমে আসার সময় উপস্থিত সবাই ‘জয় বাংলা’ বলে স্লোগান দেন। সেখানে অপেক্ষমাণ গাড়িতে চড়ে প্রধানমন্ত্রী চলে যান গণভবনে। সাধারণত দিয়াবাড়ী-আগারগাঁও অংশের ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার পথ মেট্রোরেলে যেতে সময় লাগে ১০ মিনিট ১০ সেকেন্ড। তবে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী ট্রেনটি ধীর গতিতে চলায় সময় লাগে ১৮ মিনিট।
দেশের প্রথম মেট্রোরেলের উদ্বোধন করার পর উত্তরা উত্তর স্টেশন ঘুরে দেখেন প্রধানমন্ত্রী। এই স্টেশনে একটি তেঁতুল গাছের চারা রোপণ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর ট্রেনের চালক ছিলেন মরিয়ম আফিজা, যিনি নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর করে মেট্রোরেলের চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। দেশে মেট্রোরেলের প্রথম যাত্রায় শেখ হাসিনার সহযাত্রী ছিলেন দুই শতাধিক নাগরিক, যাদের মধ্যে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী, মসজিদের ইমাম, পোশাককর্মী, রিকশাচালক, সবজি বিক্রেতা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, কূটনীতিক আর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা।
প্রসঙ্গত, মেট্রোরেলের এমআরটি-৬ লাইনের ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দিয়াবাড়ী-আগারগাঁও অংশের উদ্বোধন হলো গতকাল। ঢাকা শহরের চিরচেনা যানজট এড়াতে সাড়ে ছয় বছর আগে উত্তরায় দেশের প্রথম মেট্রোরেলের যে নির্মাণযজ্ঞ শুরু হয়েছিল, গতকাল উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে তা পরিণতি পেল। গতকাল ফলক উন্মোচন শেষে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম হাফেজ মিজানুর রহমান মোনাজাত পরিচালনা করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বোনসহ অন্যদের নিয়ে মঞ্চে বসেন। মঞ্চে ছিল ১০টি চেয়ার। আর পেছনের ব্যানারে একপাশে বঙ্গবন্ধু, অপর পাশে প্রধানমন্ত্রীর ছবি ও মাঝখানে দুটি মেট্রোরেলের ছবি শোভা পায়। ফলক উন্মোচন, সুধী সমাবেশ ও মেট্রোরেলে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা, জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি বেগম রওশন আরা মান্নান, ঢাকা-১৮ আসনের সংসদ সদস্য হাবীব আহসান, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিনুল্লা নূরী, ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি, জাইকার বাংলাদেশের প্রতিনিধি ইচিগুচি তমুহিদে, ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন সিদ্দিক প্রমুখ।
মেট্রোরেলের থিম সং : ভোগান্তির যানজট নিরসন করে সময় ও পরিবেশ বাঁচিয়ে অর্থনীতির চাকা ঘোরানোর স্বপ্ন ছিল মেট্রোরেলে, দেশের প্রথম বৈদ্যুতিক এ গণপরিবহনের উদ্বোধনী মঞ্চেও বেজে উঠল সেই সুর। বুধবার উত্তরার দিয়াবাড়ী স্টেশন প্রান্তে মেট্রোরেল উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে বাজানো হয় এর থিম সং ‘অর্থনীতির চাকা ঘুরবে পেছনে ফেলে যানজট।’ মেট্রোরেলের স্বপ্ন ও লক্ষ্য নিয়ে তৈরি করা এই গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সংগীত শিল্পী সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম। গানের কথায় বলা হয়-‘বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায়, স্বপ্নের মেট্রোরেলের শুভ যাত্রায়/ শেখ হাসিনা আজ অনন্য উচ্চতায়; মেট্রোরেল, আমাদের স্বপ্নের মেট্রো রেল/বাঁচবে সময়, বাঁচবে পরিবেশ; অর্থনীতির চাকা ঘুরবে পেছনে ফেলে যানজট, এগিয়ে চলবে বাংলাদেশ…।’ উদ্বোধনী মঞ্চে এমআরটি-৬ লাইনের সাড়ে ছয় বছরের নির্মাণযজ্ঞ শেষে পূর্ণ অবয়ব দেখানো হয় এক প্রদর্শনীতে; এরপরই বাজানো হয় মেট্রোরেলের থিম সং।
উত্তরায় লাখো মানুষের ঢল : বুধবার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে মেট্রোরেলের যাত্রা শুরুর অনুষ্ঠানে সর্বসাধারণের ঢোকার সুযোগ ছিল না, তারপরও স্টেশনের বাইরে উপস্থিত হয়ে ঢাকায় এই নতুনের শুরুর সাক্ষী হলেন অনেকে। আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সর্বস্তরের লাখো মানুষের ঢল নামে উত্তরায়। উদ্বোধন অনুষ্ঠানের স্থান দিয়াবাড়ী প্রান্তের উত্তরা উত্তর স্টেশনের বাইরে যেমন জড়ো হয়েছিলেন অনেকে, একই চিত্র ছিল আগারগাঁওয়ে। ব্যানার-ফেস্টুন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সচকিত উপস্থিতি এবং গণমাধ্যমকর্মীদের ব্যস্ততায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কিছুটা আমেজ আগারগাঁওয়ে এসে পড়েছিল। আগারগাঁওয়ে দেখা মিলল দেশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের জেলা নওগাঁর মান্দা থানা আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা জেসমিন আরার। গত এক সপ্তাহ ধরে তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন শুধু এই অনুষ্ঠানটি সচক্ষে দেখার জন্য। আগারগাঁওয়ে জড়ো হওয়া অধিকাংশই ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। তাদের অনেকে ঢাকায় এসেছিলেন গত ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে যোগ দিতে, সম্মেলন শেষে থেকে গেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের আরেকটি অর্জনের সাক্ষী হতে।
বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশে ইতিমধ্যে মানুষকে মেট্রোরেলে সেবা দেওয়া হচ্ছে। কেবল চীনেই ৪৬টি মেট্রো সিস্টেম রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে রয়েছে ১৫টি করে। অবশেষে বাংলাদেশও সেই ক্লাবে যোগ দিয়েছে। ২০১৬ সালে ২৬ জুন এমআরটি-৬ প্রকল্পের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দীর্ঘ পথ পরিক্রমা পেরিয়ে সাড়ে ছয় বছর পর তিনিই এ নতুন বাহন উদ্বোধন করলেন। প্রথম যাত্রীও তিনি। ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয়ে উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ চলছে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকার সহযোগিতায়।
ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আপতত মেট্রোরেল চলাচল করবে সীমিতভাবে। আগামী ২৬ মার্চ থেকে উত্তরা-আগারগাঁও পথে পুরোদমে যাত্রী নিয়ে চলাচল করবে মেট্রোরেল। উত্তরা-আগারগাঁও পথের জন্য ছয় কোচবিশিষ্ট ১০টি ট্রেন প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রাথমিক পরিকল্পনা হলো, প্রথম তিন মাস মেট্রোরেল মাঝের কোনো স্টেশনে থামবে না। ১০ মিনিট পরপর ট্রেন যাত্রা শুরু করবে। দিনে চলবে চার ঘণ্টা-সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। প্রতিটি ট্রেন সর্বোচ্চ ২০০ যাত্রী নিয়ে চলাচল করবে। সপ্তাহে এক দিন মঙ্গলবার ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে। অবশ্য টিকিট কাটা, ওঠানামা ও চলাচলে মানুষের অভ্যস্ততা তৈরি হলে ঘন ঘন ট্রেন চলবে, সব স্টেশনে থামবে এবং যাত্রীও বেশি নেওয়া হবে। ডিএমটিসিএল কর্মকর্তারা বলছেন, অভ্যস্ততা তৈরির পর নির্ধারিত সময় কমিয়ে আনা হতে পারে।
মন্ত্রীদের উচ্ছ্বাস : স্বপ্নের মেট্রোরেলের উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে মেট্রোর যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে যাত্রা শেষে আগারগাঁও স্টেশনে নেমে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে মেট্রোরেল নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন বেশ কয়েকজন মন্ত্রী । যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, মেট্রোরেলের মাধ্যমে নতুন এক যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। উত্তরা থেকে আগারগাঁও আসতে আগে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগত। এখন মনে হলো চোখের পলকে চলে এলাম। এটা যে কী অর্জন, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর যোগাযোগব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে।