বাংলাদেশের ভূপ্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান—এই তিন জেলা নিয়ে গঠিত। পার্বত্য অঞ্চলগুলোর মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে কৃষি ও বনায়নের মতো প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভর করে আসছে। ইদানীং অর্থনৈতিক চালকের পরিবর্তন এবং বর্ধিত নগরায়ণে সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামীণ পার্বত্য এলাকার পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। টারশিয়ারি যুগের এই পার্বত্য অঞ্চলে প্রতিদিন শত শত পর্যটক ভিড় করে থাকেন। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতি বছর ক্রমবর্ধমান বিপুলসংখ্যক দেশীয় পর্যটক বেড়াতে আসার ফলে দেশের একমাত্র বিস্তৃত পার্বত্য অঞ্চলের ভূমি ব্যবহার, ভূপ্রকৃতি ও পরিবেশের দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, সমগ্র পার্বত্য অঞ্চলের বন ও জলাভূমি ঘিরে গড়ে ওঠা পর্যটন স্পটগুলো দূষণ ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে। অপরিকল্পিত পর্যটনভিত্তিক ব্যবসার উত্থান, বিনিয়োগ, অবকাঠামো ও আবাসন নির্মাণ কর্মকাণ্ড স্থানীয় জীববৈচিত্র্য, সমৃদ্ধ ল্যান্ডস্কেপ, গ্রামীণ জনবসতি ও উর্বর কৃষিজমিকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।
পার্বত্য অঞ্চলের জেলা ও উপজেলা শহর, এমনকি অপার সৌন্দর্যের নির্জন স্থানগুলোও ধীরে ধীরে নতুন বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। এটা ভালো ব্যাপার যে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ পর্যটন থেকে কিছু আয়ের সুযোগ পাচ্ছে, আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। তবে সেই সঙ্গে এখানে-সেখানে পর্যটকদের জন্য গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট। পর্যটকদের আকর্ষণ নির্জন প্রকৃতি ও কোলাহলমুক্ত সুন্দর স্থান হলেও দিনে দিনে পর্যটকদের চাপে হারিয়ে যাচ্ছে পর্যটন স্থানগুলোর নান্দনিকতা। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অপরিকল্পিত পর্যটনের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।
চাকরি এবং অন্যান্য সুযোগের প্রলোভনে অনেক লোক নতুন বাসিন্দা হতে আকৃষ্ট হচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে নতুন বসতি স্থাপনের জন্য কৃষিজমি ও বনভূমিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হচ্ছে। গ্রামীণ এলাকায় নগরায়ণের কারণে ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনগুলো পাহাড়ের বাস্তুতন্ত্রের ওপর প্রভাব ফেলছে, স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করছে। স্বাভাবিকভাবেই পাহাড়ি ভূমি দিনে দিনে দুষ্প্রাপ্য সম্পদে পরিণত হচ্ছে। খাদ্য উত্পাদন নিশ্চিত করার জন্য কৃষিজমির সর্বোত্তম ব্যবহার এবং কৃষিজমি সংরক্ষণের পরিকল্পনা জরুরি। কৃষিকাজের জন্য উপযুক্ত জমি অত্যন্ত সীমিত সম্পদ, যা সহজে তৈরি বা প্রতিস্থাপন করা যায় না। একবার অন্য ব্যবহারে রূপান্তরিত হলে কৃষি ও বনভূমিকে উত্পাদনশীল পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত কঠিন। তাই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য ও বাসস্থানের চাহিদা মেটাতে ভূমির পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
পার্বত্য অঞ্চলগুলোর ভূপ্রকৃতি ও পরিবেশ অত্যন্ত ভঙ্গুর ধরনের হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষের কার্যকলাপের প্রভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়ে থাকে। সে কারণে একধরনের ভূমি ব্যবহার থেকে অন্য কাজে জমির দ্রুত ও ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনের ফলে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হতে পারে। যেমন ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে প্রতিনিয়ত অপরিকল্পিতভাবে কৃষিজমি বা বনাঞ্চলে পর্যাপ্ত রাস্তাঘাট ও স্যানিটেশন অবকাঠামো ছাড়া হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট ও বসতি এলাকা সম্প্রসারিত হচ্ছে। বিগত কয়েক দশকে ব্যক্তি ও সামষ্টিক প্রয়োজনে দ্রুত পার্বত্য এলাকার জমির ব্যবহারের পরিবর্তনের ঘটনা হামেশা দেখা যাচ্ছে। অপরিকল্পিত হোটেল নির্মাণের বিশেষ উদাহরণ হলো বগা হ্রদ ও সাজেক উপত্যকার আশপাশের এলাকা। যেখানে দিনে দিনে নষ্ট হচ্ছে পাহাড় দেখার সৌন্দর্য আর লেক দেখার অপরূপ ভিউ। আবাদিসহ অন্যান্য জমির পরিমাণ হ্রাস করে স্থানীয় মানুষকে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকিতে ফেলে দিচ্ছে এবং পাহাড় জুড়ে ও তার বাইরে বাস্তুতন্ত্র পরিষেবার প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে। ভূমি ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রয়োজনীয় পানির সংকট বেড়েই চলেছে। পানির উত্স যেমন ঝিরি, ঝরনা বা খাল শুকিয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রচলিত কৃষির পরিবর্তে নতুন ধরনের কৃষির প্রচলন হয়েছে এবং দেশীয় গাছের পরিবর্তে অসহজাত গাছের প্রচলন ঘটেছে। মাটির ক্ষয় এবং প্রাকৃতিক বৃক্ষের আচ্ছাদন পরিবর্তন পাহাড়ি অঞ্চলে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। পানির সহজলভ্যতা যেমন কমে যাচ্ছে, তেমনি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে, ঐতিহ্যবাহী ফসলের উত্পাদন কমছে, এমনকি বন্দরে পলির সমস্যা বাড়ছে। অধিকন্তু, পার্বত্য অঞ্চলে ঘন ঘন ভূমিধস, জলাবদ্ধতা ও বন্যার সম্মুখীন হচ্ছে। সঠিক পারস্পরিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন ছাড়া গৃহস্থালি ও কৃষিকাজে পানির সরবরাহ সম্ভবত আগামী দিনে আরো হ্রাস পাবে। ফসলি জমি আরো সংকুচিত হবে এবং ঐতিহ্যবাহী জীবন-জীবিকা ব্যাহত হবে। অনেকেই মনে করেন, সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া ভূমি ব্যবহারের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন স্থানগুলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারিয়ে বস্তিসদৃশ হয়ে যাবে, এমনকি পর্যটকদের আকর্ষণ মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে।
ভূমির ব্যবহার পরিকল্পনার প্রারম্ভিক ধাপ হলো ভূমিকে সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য শ্রেণিবিভাগ করা। যেমন—কৃষিভূমি, আবাসিক এলাকা, পর্যটন স্থান, বনভূমি, জলাভূমি, উদ্যান, প্লাবনভূমি ইত্যাদি চিহ্নিত করা। তারপর বিশেষজ্ঞ ও বাসিন্দাদের সম্মতিভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ভূমির ব্যবহার নির্ধারণ করা। উদাহরণস্বরূপ, ভূমির ব্যবহার পরিকল্পনাকারীদের সাহায্যে স্থানীয় লোকেরা নির্ধারণ করতে পারেন যে, পর্যটন হোটেল ও মোটেল জোনের কত ভাগ রাস্তার জন্য রাখা উচিত। রাস্তার স্থান সুনির্দিষ্ট করে ও অন্যান্য ইউটিলিটি সেবার জন্য স্থান ছেড়ে দিয়ে মানুষ হোটেল, মোটেল ও পর্যটকদের হোম আবাসন নির্মাণ করবে। সেই সঙ্গে কোথায় এবং কত তলা হোটেল নির্মাণের ফলে মনোরম স্থানটির ক্ষতি হবে না, সব হোটেল থেকে দর্শনীয় স্থানের ভিউ ভালো থাকবে তা নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য অপরিকল্পিত হোটেল নির্মাণের কারণে পর্যটন স্থানগুলোর যে স্কাইলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রণ করা খুবই জরুরি।
একইভাবে, ভূমির ব্যবহার পরিকল্পনা প্রোটোকলগুলো পাহাড়ি অঞ্চলে ঝিরি ও ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ার মতো কিছু বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে পারে। এছাড়া ঝিরি ও ঝরনা পুনরুদ্ধারের জন্য কী ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে, সে বিষয়ে জনগণকে সচেতন করে তোলা। যদিও বাংলাদেশে বাড়ি বা রাস্তা নির্মাণের পর গাছ লাগানো একটি প্রচলিত ব্যাপার। এ ক্ষত্রে ভূমি ব্যবহারের পরিকল্পনা মানুষকে আরো এক ধাপ এগিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে। ভূমি ব্যবহারের পরিকল্পনা ঝরনা পুনরুদ্ধার করতে, মাটির ক্ষয় রোধ করতে এবং মাটির আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে দেশীয় প্রজাতির কোন ধরনের গাছ সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত হবে তা নির্ধারণে সাহায্য করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, কোন গাছপালা পাখির জন্য উন্নত আবাসস্থল প্রদান করে বাস্তুতন্ত্রের কার্যকারিতা রক্ষা করবে এবং যা পার্বত্য চট্টগ্রামে পাখি ও প্রকৃতিভিত্তিক পর্যটনকে আকর্ষণীয় করে তুলবে। এ ধরনের পরিকল্পনা শুধু বৃক্ষরোপণ কার্যক্রমের মধ্যে না থেকে অন্যান্য সম্পর্কিত উদ্যোগের ওপর জোর দিতে পারে, যেমন—কোথায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর রিচার্জ করার জন্য ছোট রিটেনশন পুকুর নির্মাণ করা উচিত।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য ভূমি ব্যবহারের পরিকল্পনা প্রক্রিয়া অবশ্যই টেকসই উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি পুনরাবৃত্তিমূলক এবং চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হতে হবে। এ ধরনের পরিকল্পনা সুন্দরভাবে প্রণয়নের জন্য দূর অনুধাবন ও ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ব্যবহারকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। দূর অনুধাবন ও ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অতীতে ভূমির অবস্থা কেমন ছিল, বর্তমানে কেমন অবস্থায় আছে এবং ভবিষ্যতে ভূমি ব্যবহারের ওপর কেমন প্রভাব পড়বে, বিকল্প পরিস্থিতি, ঝুঁকি নিরূপণে সহায়তা করবে। একটি ভূমি ব্যবহার পারস্পরিক মহাপরিকল্পনা পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড বা অন্য কোনো সরকারি সংস্থা স্থানীয় বসতিদের সঙ্গে সমন্বয় করে বাস্তবায়ন করতে পারে। তবে কোনো কারণে সব অঞ্চলে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা সম্ভব না হলে একটি স্থানকে মডেল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। মডেল প্ল্যান থেকে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা পরবর্তী সময়ে দেশের অন্যান্য অংশে পরিকল্পনা প্রণয়নে দারুণ সহায়ক হতে পারে। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পদ্ধতির নির্দেশনা দিতে পারে, যাতে পার্বত্য ল্যান্ডস্কেপগুলোতে ন্যূনতম ক্ষতি না করে ভূমির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
আগামী প্রজন্মের জন্য বসবাসকারী সম্প্রদায়গুলোর অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নতি একান্ত কাম্য। পার্বত্য চট্টগ্রামের উজ্জ্বল ভবিষ্যত্ আমাদের হাতে, যদি আমরা এর জন্য ভালো পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারি।