ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ ঋণ হিসেবে প্রদানের ব্যাপারে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং ঋণদানের শর্ত নির্ধারণের জন্য আইএমএফের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছে। এই প্রতিনিধিদল আর্থিক সেক্টরসহ বিভিন্ন খাতের সংস্কারের জন্য বাংলাদেশকে পরামর্শ দিয়েছে। এই পরামর্শ বা শর্তের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হিসাবায়ন পদ্ধতি পরিবর্তন করতে চলেছে। এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রস রিজার্ভের পরিবর্তে নিট রিজার্ভ হিসাবায়ন করবে। এতে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কমে যাবে। একইভাবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) হালনাগাদ তথ্যের ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি নির্ধারণের উদ্যোগ নিয়েছে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতির যে হিসাব করা হয়, তার ভিত্তি ধরা হয় ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরকে। অর্থনীতিবিদদের অনেক দিন ধরেই মূল্যস্ফীতি হিসাবায়নের ভিত্তি বছর হালনাগাদ করার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। আইএমএফের আর্থিক খাত সংস্কারের যে শর্তারোপ, তার সঙ্গে মূল্যস্ফীতির ভিত্তি বছর হালনাগাদকরণ ও গণনা পদ্ধতির কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা বলা হচ্ছে না।
তবে বিষয়টি নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। ভিত্তি বছর ও গণনা পদ্ধতি পরিবর্তন করা হলে নিশ্চিতভাবেই মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। মূলত মূল্যস্ফীতি কমিয়ে দেখানো এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দেখানোর জন্যই ভিত্তি বছর পরিবর্তন করা হয়নি। গত আগস্ট মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। নভেম্বর মাসে তা কিছুটা কমে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ নেমে এসেছে। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের অধিকাংশই পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া মূল্যস্ফীতির এই হার তেমন একটা বিশ্বাস করেন না। তারা মনে করেন, ভিত্তি বছর হালনাগাদ করা হলে মূল্যস্ফীতির হার অনেকটাই বেড়ে যাবে। কারণ ভিত্তি বছর পরিবর্তন না করার কারণে ভোক্তা চাহিদা এবং ব্যয়ের চিত্র সঠিকভাবে ফুটে উঠছে না। গত ১৭ বছরে দেশের অর্থনীতির অনেক কিছুই পালটে গেছে। এগুলো জাতীয় পরিসংখ্যান প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হওয়া প্রয়োজন।
ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতির হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে শুধু ভিত্তি বছর পরিবর্তন করা হবে তা নয়, একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির প্রোডাক্ট বাস্কেটও সম্প্রসারিত করা হবে। বর্তমানে ৪২৬টি পণ্য ও সেবার মূল্য হ্রাস-বৃদ্ধির গতি-প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে মূল্যস্ফীতির হার নির্ধারণ করা হয়। ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে পণ্য ও সেবা খাতের সংখ্যা আরও বাড়িয়ে ৫২৫ থেকে সাড়ে ৫৫০-এ উন্নীত করা হতে পারে। একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি গণনার ক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে। জাতিসংঘ কর্তৃক অনুমোদিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ইনডিভিজুয়াল কনজাম্পশন অ্যাকর্ডিং টু পারপাস (কইপক) ২০১৮’ মোতাবেক মূল্যস্ফীতি হিসাবায়ন করা হবে। এই পদ্ধতিতে ভোক্তার চাহিদা ও ব্যয়ের প্রবণতা ধরে মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করা হয়। নতুন পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি গণনার ক্ষেত্রে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরকে ভিত্তি ধরা হবে। নতুন পদ্ধতিতে এবং হালনাগাদ ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতির হার নির্ধারণ শুরু হলে আমাদের অনেক অর্জনই প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে পারে। তবে শুধু মূল্যস্ফীতির হিসাব পদ্ধতি পরিবর্তন এবং ভিত্তি বছর হালনাগাদ করলেই দায়িত্ব শেষ হবে না। একই সঙ্গে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হিসাবায়নের ভিত্তি বছর ও পদ্ধতি নিয়েও ভাবতে হবে। বিশেষ করে জিডিপি বাস্কেট বাড়ানো একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। যেসব পণ্য ও সেবাকে ভিত্তি ধরে জিডিপি হিসাব করা হয়, তা সম্প্রসারণের আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। গৃহকর্মে নিযুক্ত নারী শ্রমিকদের কাজের কোনো মূল্যায়ন বর্তমান পদ্ধতিতে করা হচ্ছে না। একই সঙ্গে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যারা কর্মরত আছেন, তাদের উপার্জন ও পরিশ্রম জিডিপিতে যুক্ত হচ্ছে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা ধরনের আর্থিক খাত বিকশিত হয়েছে। সেগুলো জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, বাংলাদেশে যারা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত আছেন, তারা জাতীয় অর্থনীতিতে যে অবদান রাখছেন, তার হার বা পরিমাণ দৃশ্যমান বা আনুষ্ঠানিক জিডিপির ৮৭ শতাংশের সমান। অর্থাৎ, তাদের এই অবদান যদি জিডিপিতে সঠিকভাবে যুক্ত হতো, তাহলে বর্তমান অবস্থাতেই আমাদের জিডিপির আকার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যেত।
বাংলাদেশে অর্থনীতি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ (বিসিজি) তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশমান ধারা তুলে ধরেছে।
সংস্থাটি বলছে, দ্রুত বর্ধনশীল দেশের তালিকায় ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো দেশকে অতিক্রম করে গেছে বাংলাদেশ। বর্তমান প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রেখে বাংলাদেশ যদি বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশে অব্যাহত রাখতে পারে, তাহলে ২০৪০ সালে দেশটির মোট জিডিপি এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ল্যান্ড মার্ক স্পর্শ করবে। আর যদি প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশে উন্নীত করতে পারে, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যেই এই অর্জন সম্ভব। ২০২১ সালে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ছিল ৪১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশে একটি বিশাল ভোক্তা শ্রেণি বিকশিত হচ্ছে। তিন দশক আগে দেশে মধ্যবিত্ত পরিবারের হার ছিল ১২ শতাংশ। বর্তমানে তা ২০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিকাশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের অধিকাংশের আদি বাসস্থান গ্রামীণ এলাকায়। তারা যে অর্থ পাঠায়, তা লোকাল বেনিফিশিয়ারিরা জমি ক্রয়, বাড়ি নির্মাণসহ ভোগবিলাসে ব্যয় করে থাকেন। ফলে দীর্ঘ মেয়াদে রেমিট্যান্স বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে তেমন কোনো অবদান রাখতে না পারলেও গ্রামীণ অর্থনীতিতে জৌলুস বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। জিডিপি গঠনে ভোক্তা ব্যয় ৬৮ দশমিক ৮ শতাংশ অবদান রাখছে। বিনিয়োগে অবদান রাখছে ৩১ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি খাতে বিনিয়োগের হার ১০ শতাংশ। সরকারি ব্যয়ের হার ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। জিডিপি গঠনে কৃষি খাতের অবদান ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। ২০১১ সালে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল ১৭ শতাংশ। বর্তমানে তা ১২ শতাংশে নেমে এসেছে। একই সময়ে শিল্প খাতের অবদান ২৫ শতাংশ থেকে ৩৩ শতাংশে বৃদ্ধি হয়েছে। সেবা খাতের অবদান ৫৩ শতাংশ থেকে কমে ৫১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মেয়াদে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত থাকলেও তা অর্জিত হয়নি। অবশ্য এই সময়ে সরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রত্যাশার চেয়েও বেড়েছে। অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, সরকারি খাতে বিনিয়োগ অস্বাভাবিক মাত্রায় বৃদ্ধির অর্থ হচ্ছে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটানো। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প জাতীয় অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও তা জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। কাজেই জিডিপির পরিধি আরও সম্প্রসারণ করা এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে—এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সেই উন্নয়ন কতটা টেকসই ও দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে তৈরি পোশাকশিল্প। গত অর্থবছরে (২০২১-২০২২) বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে রপ্তানি খাত থেকে। এর মধ্যে ৪২ বিলিয়ন ডলারই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। কিন্তু তৈরি পোশাক খাতটি আমদানিকৃত কাঁচামালনির্ভর। এই খাতের জন্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি করতে হয়। এতে মোট রপ্তানি আয়ের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশই পুনরায় বিদেশে চলে যায়। ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে এই খাতের মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে কম। এছাড়া আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য সীমিতসংখ্যক দেশ ও সামান্য কয়েকটি পণ্যের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হচ্ছে। যেসব দেশ থেকে আমরা বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করি, সেসব দেশে আমাদের রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম। বিনিয়োগ আহরণের প্রসঙ্গ উঠলেই আমরা আবেগে গদগদ হয়ে বলি, বাংলাদেশে সস্তায় বিপুলসংখ্যক শ্রমিক পাওয়া যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে, অদক্ষ ও অপ্রশিক্ষিত শ্রমিকের মজুরি সস্তাই হয়। উচ্চ প্রশিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমিক কখনোই সস্তায় পাওয়া যায় না। কাজেই সস্তা শ্রমিক প্রাপ্তি কোনো কৃতিত্ব নয়, বরং এটা আমাদের ব্যর্থতা। বাংলাদেশ থেকে শ্রমিকেরা বিদেশে যান কাজ করার জন্য। আর বিদেশ থেকে দক্ষ শ্রমিক ও টেকনিশিয়ানরা আমাদের দেশে কাজ করে প্রতি বছর ৬ থেকে ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নিয়ে যাচ্ছেন।
মূল্যস্ফীতি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতেই প্রণীত হওয়া প্রয়োজন। ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে কৃতিত্ব নেওয়ার কোনো মানে থাকতে পারে না।