‘এসো, শুনো বনভূমির লিনেটের সুর,
কত মধুর তার গান!’
—উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ
তখন সবে সূর্যের কিরণ পাহাড় ডিঙিয়ে ফসলের মাঠে পড়েছে। বার্লির কচি শিষে রবির আলো পড়ার পর এমন এক সোনালি রং তৈরি হয়েছে যে রঙের আভা ও সৌন্দর্য সেদিন পুরোটা সময় অনুভব করেছি। আমি তখন শিশিরে ভেজা ফসলের মাঠের আল দিয়ে পাখি দেখার জন্য হাঁটছি।
এমন সময় দুটি পাখি উড়ে এসে বসল ফসলহীন মাঠের এক প্রান্তে। ওদের ডাকাডাকির সুর খুবই রোমান্টিক। একটি পাখির বুক ও মাথার পালক লাল রঙের। রোদের আলো পড়ে গোলাপি রংটা আরও তীব্রভাবে আকর্ষণ করছে মনকে। বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে বুঝতে পারলাম এরা লিনেট। লাল রঙের পাখিটি পুরুষ। ওরা মাঠে কিছুটা সময় কাটিয়ে ও জল খেয়ে উড়ে চলে গেল।
প্রতিদিন সূর্যোদয়ের আধা ঘণ্টা আগে আমাদের পাখি গবেষণার সাইটগুলোতে উপস্থিত থাকতে হয়। আমাদের গবেষণার জন্য প্রায় সাতটি সাইট রয়েছে। যে প্রজাতির পাখি নিয়ে কাজ করছি, তার নাম ওরটোলান বান্টিং। এই গবেষণার পাশাপাশি জার্মানির দারুণ সব গ্রাম, শহর, নদী ও ছোট পাহাড়ের রূপ-লাবণ্য খুব সকালে উপভোগের আনন্দটাই আলাদা।
ঘণ্টা দুয়েক পর আবার সেই লিনেট যুগলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মাঠের মাঝখান দিয়ে এক লম্বা হেজের (গাছ ও গুল্মের লম্বা ঝোপ) একটি চেরিগাছের পাশের ঝোপে প্রায় দুজন উড়ে এসে বসে। একসঙ্গে আবার উড়ে যায়। আমার কাছে তেমন খটকা লাগল না, বুঝে গিয়েছি যে এখানে ওদের বাসা। কাটা কাটা একহারা সুরে গান গাইতে গাইতে তারা উড়ে বেড়াচ্ছে।
এখন আসলে তাদের প্রেমের দিন। বাইনোকুলার দিয়ে লক্ষ করলাম, উড়ে তারা নিকট দূরে সুগারবিটখেতে গিয়ে বসে। স্ত্রী পাখিটি খড়কুটো সংগ্রহ করে ঠোঁট দিয়ে। অন্যদিকে পুরুষ পাখিটি সুগারবিটের পাতায় বসে গান গায়। সে বাসা তৈরির উপকরণ সংগ্রহ করে না। কেবল প্রেমিকাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে আসে ও যায়। এমনকি বাসার কাছে কোনো মানুষের উপস্থিতি টের পেলে, সে সামনে এসে ডাকাডাকি করে আর স্ত্রী পাখিকে পাতার আড়ালে লুকিয়ে রাখে।
সেদিন কেবল ওদের গান, প্রেম, ওড়াউড়ি ও বাসা তৈরির ব্যস্ততা পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছিলাম। সুন্দর সকালের মতো লিনেট পাখির রং এবং মনোরম গানের সুর ও টুইট ভুলতে পারছিলাম না! লিনেটের গানে সুরের মুগ্ধতা পশ্চিমা সাহিত্য, কবিতা, নাটক ও গানে দারুণভাবে প্রভাব ফেলেছে। রোমান্টিক ব্রিটিশ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, চার্লস ডিকেন্স, লর্ড টেনিসন তাঁদের লেখায় লিনেট পাখির কথা বলেছেন। ক্ল্যাসিক ব্রিটিশ মিউজিক ‘ডোন্ট ডিলি ড্যালি অন দ্য ওয়ে’তে লিনেটের কথা আছে। লিনেট পাখির নামে একটি ডাচ মিউজিক ব্যান্ডের নামকরণ করা হয়েছে।
লিনেট ঘন ঝোপসহ খোলা জমি, গুল্মের ঝোপ ও বাগানে বিচরণ করে। ঝোপের মধ্যে বাসা তৈরি করে, চার থেকে সাতটি ডিম পাড়ে। প্রজনন মৌসুমের বাইরে বড় ঝাঁকে চলে, কখনো কখনো অন্যান্য ফিঞ্চ প্রজাতির পাখির সঙ্গে মিশে যায়। এরা প্রধানত বীজ খেয়ে থাকে। তাদের খাদ্যে অমেরুদণ্ডী প্রাণীরাও রয়েছে। লিনেট সাধারণত ইউরোপ, পশ্চিম প্যালের্কটিক ও উত্তর আফ্রিকায় বংশবৃদ্ধি করে।
লিনেট হলো লম্বা লেজবিশিষ্ট পাখি। ওপরের অংশ বাদামি, গলা সাদা। গ্রীষ্মকালীন পুরুষ পাখির রং ধূসর ও লাল বর্ণের মিশেল। স্ত্রী ও তরুণ পাখিদের লাল রঙের পালক থাকে না। তাদের পালকের রং সাদা ও বাফ স্ট্রিকড।
লিনেট হলো ফিঞ্চ পরিবারের একটি ছোট প্যাসারিন পাখি। ১৭৫৮ সালে সুইডিশ প্রকৃতিবিদ কার্ল লিনিয়াস এর নামকরণ করেন। মাঠে আগাছানাশকের বেপরোয়া ব্যবহারের কারণে, গুল্ম অপসারণের জন্য এদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।