সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ২০২২ সালে দেশে ৫ হাজার ৭০টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছে ৫ হাজার ৭৬০ জন। আগের বছরের তুলনায় বিদায়ি বছরে সড়কপথে ২ হাজার ৪১৫ জনের মৃত্যু বেশি হয়েছে। এটি নিরাপদ সড়ক চাই-নিসচার তথ্য।
এছাড়া বিভিন্ন সংগঠন সড়ক দুর্ঘটনার যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে ভিন্ন ভিন্ন চিত্র উঠে এসেছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর যাত্রীকল্যাণ সমিতি বলছে, একই সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৯ হাজার ৯৫১ জন। সবার হিসাবেই ২০২২ সালে মৃত্যু বেড়েছে। এছাড়া গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৪২০ জন পথচারীর মৃত্যু হয়েছে, যা খুবই উদ্বেগের।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা দিবসের ছড়াছড়ি। তেমনি একটি দিবস হচ্ছে ‘নিরাপদ সড়ক দিবস’। ২০১৭ সালের ৫ জুন মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে ২২ অক্টোবরকে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর পর থেকেই প্রতিবছর গুরুত্বের সঙ্গে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষ্যে বাণী-বিবৃতিও প্রকাশিত হচ্ছে। সভা-সেমিনারে উচ্চারিত হচ্ছে অগ্নি উদ্গারী ভাষণ। কিন্তু সমস্যা যে তিমিরে ছিল, সেখানেই রয়ে গেছে।
১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর এক সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রীকে হারানোর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন চলচ্চিত্র অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন। তারপর থেকেই খানিকটা গতি পায় এই আন্দোলন। সড়কে আর যেন রক্ত না ঝরে, এটিই হচ্ছে দিবসের মূল সুর।
সড়ক দুর্ঘটনায় একটি বড় অংশ মারা যায় শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ৭০৬ জন শিক্ষার্থী ও ৫৪১টি শিশু, যা মোট মৃত্যুর প্রায় ১৯ শতাংশ। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই দুই শিক্ষার্থী নিহত হন। সেদিন ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের প্রতিযোগিতায় রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ঐ দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়েছিলেন। এরপর নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আসে। রাজপথে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে গাড়ি আটকে কাগজপত্রও দেখে, লাইন মেনে গাড়ি চলাচলে বাধ্য করে। কিন্তু সেই লাইন বেশি দিন টেকসই হয়নি।
ছাত্রদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপদ সড়ক আইন আরও যুগোপযোগী ও কঠোর করা হয়। ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সংসদে ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ পাশ হয়। ৮ অক্টোবর গেজেট জারি হয়। পরে আইনটি সেভাবে আর কার্যকর হচ্ছে না। কারণ আইনটিতে পরিবর্তন আনার দাবি জানিয়েছিলেন পরিবহন শ্রমিকেরা। পরে ১৩ মে ২০২১-এ পরিবহন শ্রমিকদের চাপের মুখে সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর আইনটি অরেকটা হিমঘরে আছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। কেননা, নিত্যদিনের দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানই তা বলে দিচ্ছে।
সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নানা রকম সুপারিশ এসেছে বিভিন্ন সময়ে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার। স্কুলের পাঠ্যক্রমে সড়ক দুর্ঘটনা রোধের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করা, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠানো-নামানো, ওভারটেকিং, পালটাপালটি ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত যাত্রী ও মাল বোঝাই করা, গাড়ির ছাদে যাত্রী বহন করা, ওভারব্রিজ কিংবা আন্ডারপাস বা জেব্রাক্রসিং থাকা সত্ত্বেও সেগুলো ব্যবহার না করার প্রবণতাকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
এছাড়া পথচারীদের নির্বিঘ্নে চলাচলের জন্য ফুটপাত দখলমুক্ত করে যেখানে ফুটপাত নেই সেখানে ফুটপাত তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে এবং নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে আবার যেন ফুটপাত দখল না হয়, এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সড়কের ত্রুটিগুলো অচিরেই দূর করতে হবে। সরকার কর্তৃক গৃহীত ‘সেইফ’ প্রকল্পের মাধ্যমে ১ হাজার ৪১০ জন গাড়িচালক প্রশিক্ষক তৈরি এবং ৩ লাখ গাড়িচালককে আপগ্রেডিংয়ের জন্য ১২ ও ২৪ দিনের প্রশিক্ষণ কর্মশালার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হলে লাইসেন্সবিহীন চালকেরা ২৪ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে বৈধ লাইসেন্সের আওতায় আসবে এবং হালকা ও মধ্যম গাড়ির চালকেরা ১২ দিনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই ভারী গাড়ির লাইসেন্স পাবে, যা দেশে দক্ষ চালক সমস্যার সমাধানে সহায়ক হবে।
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু শুধু একটি পরিবারে গভীর শোক ও ক্ষত সৃষ্টি করে না, আর্থিকভাবেও পঙ্গু করে ফেলে ঐ পরিবারকে। কোনো কোনো দুর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি প্রাণ হারান। তখন ঐ পরিবারের যে কী অবস্থা হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যারা পঙ্গুত্ব বরণ করে, তাদের পরিবারের অবস্থা আরও করুণ, আরও শোচনীয়।
এটা খুবই দুঃখজনক যে, অনেক চেষ্টার পরও সড়কে নিরাপত্তা ও পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে পারছে না সরকার। জোরালো অভিযোগ রয়েছে, পরিবহন আইন ও নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর একচেটিয়া প্রাধান্যের কারণেই এই খাতে শৃঙ্খলা আসছে না। এছাড়া সরকার, পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠন একাকার হয়ে গেছে। ফলে সিদ্ধান্ত হয়, কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। আইন আছে, কিন্তু এর প্রয়োগ করতে গেলেই বাধা আসে। ফলে রক্ষা হচ্ছে না যাত্রীস্বার্থ। অকাতরে প্রাণ যাচ্ছে সড়কে। তাহলে নিরাপদ সড়ক কি অলীক কল্পনার বিষয় হয়েই থাকবে?
যানবাহনের উচ্চগতি, নাজুক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত সমস্যা, পরিকল্পনা ও নীতির দুর্বলতা, অসচেতনতার বিষয় সড়ক দুর্ঘটনা ত্বরান্বিত করছে। তাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কর্তৃপক্ষকে সেই সব সমস্যা দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, এক বছরে প্রায় ২০ হাজার ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ হাজার মানুষ নিহত হয়। আহত হয় ১ লাখ। এদের বেশির ভাগই পঙ্গুত্ব বরণ করে।
দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবাই কমবেশি জানেন। বহুবার এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—দেশে সড়ক অবকাঠামো এবং স্থলভাগের আয়তন অনুপাতে জনসংখ্যার চাপ বেশি। সড়কের তুলনায় মোটরযানের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। একই সড়কে চলছে বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, রিকশাসহ নানা রকম মিশ্র যানবাহন। উপরন্তু, সড়ক ও মহাসড়কগুলো ত্রুটিপূর্ণ। দেশব্যাপী মহাসড়কের অনেক স্থানেই রয়েছে বিপজ্জনক বাঁক। এসব বাঁকের কারণে প্রায়ই সেই সব জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটছে।
এছাড়া অবকাঠামোগত কারণেও দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি ও ঝুঁকি খুব বেশি বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। সম্প্রতি দুর্ঘটনা মহামারির আকার ধারণ করার জন্য যেসব কারণকে দায়ী করা হচ্ছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চালকের অসতর্কতা ও বেপরোয়া গাড়ি চালানো। এ সমস্যা বারবার চিহ্নিত হলেও এর কোনো প্রতিকার নেই।
প্রতিবার দুর্ঘটনার পরপরই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই তদন্ত প্রতিবেদন কোনো দিন আলোর মুখ দেখে না। সংগত কারণেই দোষী ব্যক্তিদের শাস্তিও হয় না। সমাজের উঁচু স্তর থেকে নিচু শ্রেণির মানুষ যারাই দুর্ঘটনার শিকার হন না কেন, কোনো একটি ঘটনার বিচার হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত মেলা ভার। বিচারহীন, প্রতিকারহীন অবস্থায় কোনো কিছু চলতে থাকলে সেটির পুনরাবৃত্তিও তো ঘটবেই।
প্রতি বছর ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করা হয়। সচেতন করা হয় সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু সমস্যা থেকে যায় তিমিরেই। সড়ক দুর্ঘটনা হয় না এমন দেশ নেই। কিন্তু দুর্ঘটনার সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতি যত কমিয়ে আনা যায়, সেটিই লক্ষ্য হওয়া উচিত। ভালো যান, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালক, সড়কব্যবস্থা উন্নতকরণ, সিগন্যালিং ব্যবস্থা আধুনিক ও যুগোপযোগী করার বিষয়গুলো তো রয়েছেই। এর সঙ্গে দুর্ঘটনায় পতিতদের ত্বরিত চিকিৎসা পাওয়ার বিষয়টিও অত্যন্ত জরুরি। অনেক সময় আইনি জটিলতার কারণে আহতদের চিকিৎসা দিতে সমস্যা হয়। এই সমস্যা সমাধানেও ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিটি সড়ক-মহাসড়ক হোক নিরাপদ—এটাই কাম্য।