আমেরিকার অলিভার আর নরওয়ের মারিয়ানদের সঙ্গেই রওনা হলাম কেপ ভার্দের ব্লু আই দেখার জন্য। জীবন বৈচিত্র্যময়। এরই মধ্যে আমার ১৫৯ দেশ ভ্রমণ হলো। জীবনের কোন মোহনায় কখন কার সঙ্গে দেখা হবে আমরা জানি না। জিপ গাড়ির মধ্যেই তাদের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। গল্প করতে করতে আমরা কী অসাধারণ ওয়াইল্ড নেচার দেখতে দেখতে ছুটতে থাকলাম। খোলা দিগন্ত, চারদিকে সমুদ্র, মধ্যখানে একখণ্ড জমিনের ওপরে অপূর্ব সব রহস্য ঘিরে এই সালদ্বীপ। যেতে যেতে দেখতে পেলাম ছোট ছোট রকগুলো কোথাও কোথাও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ছোট ছোট রকগুলোর পাশ ঘেঁষে আমরা একসময় পৌঁছে গেলাম সমুদ্রের কিনারার সেই ব্লু আইয়ের কাছাকাছি। ঠিক তখন দুপুরের কড়া রোদ মাথার ওপর হালকা সামুদ্রিক বাতাস বইছে। কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে আমি সমুদ্রের কাছাকাছি সেই ব্লু আই বা নীল চোখ দেখতে পেলাম। কী অসাধারণ! সত্যিতো একটি নীল চোখ দেখতে পাচ্ছি সমুদ্রের পানির মধ্যে ভেসে আছে সেই গভীর গুহার ভেতর। হাজারো টুরিস্টের মাঝে আমার কয়েক মিনিট সুযোগ হলো সেই ব্লু আইকে দেখার। চারদিকে ছোট ছোট পাথর ঘেরা এই গুহার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ব্লু আই। আল্লাহর সৃষ্টি কী অসাধারণ। এই রহস্যময় সমুদ্রের পানির মধ্যে ভেসে আছে এই নীল চোখ।
কেপ ভার্দের সবচেয়ে বেশি পরিদর্শন করা ‘সালদ্বীপের’ উত্তর-পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত ব্লু আই হলো একটি প্রাকৃতিক ডুবোগুহা যা আগ্নেয়গিরির শিলা থেকে তৈরি হয়েছে। এটি ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের মাধ্যমে সমুদ্রের সঙ্গে সংযুক্ত। গুহার মধ্যে পানির স্তর পার্শ্ববর্তী সমুদ্রের জোয়ারের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে।
ব্লু আই কেপ ভার্দের দ্বীপগুলোর মধ্যে অবস্থিত অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ। এই বিশেষ গুহাটি হাজার হাজার বছরের ক্ষয় এবং আগ্নেয়গিরির ক্রিয়াকলাপের ফলাফল। কারণ আগ্নেয়গিরির শিলাটি আটলান্টিক মহাসাগরের তরঙ্গের ধ্রুবক বাঁধের নিচে রয়েছে। গুহার ছাদের একটি অংশ ধসে পড়েছে, যা ভূমি থেকে ২৪ মিটার গুহার উপরের অংশ থেকে দর্শনার্থীদের দেখতে দেওয়া হয়।
ব্লু আইয়ের গভীরতা অনেক বেশি। উপর থেকে তাকালে নিচের দিকে একটু ভয়ংকর মনে হবে। কারণ, এর গভীরতা অনেক দীর্ঘ। কখনো কখনো পরিব্রাজকরা এই পুলে সাঁতার দিতে পারেন। সমুদ্রের ঘূর্ণি এবং বাতাস উঠার দিনগুলো সম্ভাব্য পুল সাঁতারুদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। যখন বড় ঢেউ উঠতে শুরু করে এবং মেঘের ছায়া আগ্নেয় শিলার ওপর পড়ে তখন অন্ধকূপের মতোই মনে হয়। আটলান্টিকের ঘূর্ণায়মান জলের মধ্যে আঘাত এড়াতে মাঝারি আবহাওয়া এবং কম বাতাসের সময়গুলোতে সাঁতারের দিনগুলো নির্ধারিত হয়।
‘ব্লু আই’ অভিজ্ঞ ডুবুরিদের আটলান্টিকের পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য এবং ডুবোগুহার অনেকগুলো লুকানো গুহা অন্বেষণ করার জন্য একটি দুর্দান্ত স্থান, যাতে সমুদ্রের ভেতরে বসবাসকারী সমৃদ্ধ সমুদ্রজীবন অবলোকন করতে পারে ডুবুরিরা। ডুবুরিরা ব্লু আই নামক এই প্রাকৃতিক আন্ডারওয়াটার টানেলের মাধ্যমে আটলান্টিক মহাসাগরে প্রবেশ করতে পারে। এ অসাধারণ ব্লু আই দেখা শেষ করে আমি আটলান্টিকের পানি স্পর্শ করে বিকালের নরম রোদের টলমলে ঝিলিমিলির মাঝে আমার সহযাত্রীদের সঙ্গে আবার রওনা হলাম সালদ্বীপের পালমিরা টাউনের দিকে। আমার দুই চোখ জুড়ে এখনো সমুদ্রের সেই নীল চোখের দ্যুতি যেন গভীর ভালোবাসার দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এভাবেই পৃথিবীর রহস্যে ঘেরা স্মৃতি নিয়ে আমি ফিরে আসি।