নিরাপদ ও পরিমিত খাদ্য গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, যত টেস্টি খাবার সেটি ততই অনিরাপদ। পরিমিত খাবার খেয়েও আপনি সারা দিন কাটাতে পারবেন। আমি কিন্তু না খেয়ে থাকার কথা বলছি না। না খেয়ে কেউ মারা যায় না, বেশি খেয়েই মারা যায়।
গত ৩ জানুয়ারি রাজধানীর বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) আয়োজিত জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ‘নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক পারিবারিক নির্দেশনার ভূমিকা’ শীর্ষক এক সেমিনারে খাদ্যমন্ত্রী বেশকিছু উদাহরণ তুলে ধরে আরো বলেন, অনেককে দেখেছি খেয়েই মারা গেছে। বিয়ে খেতে গিয়ে খাচ্ছে তো খাচ্ছেই, পরে সেই রাতেই স্ট্রোক করেছে। আরেক ছেলে হাসের মাংস খেয়ে মোটরসাইকেল এক্সিডেন্ট করেছে। এমন অনেক উদাহরণ আছে। তাই পরিমিত ও নিরাপদ খাদ্য খেতে হবে। অনেকেই কোন খাদ্যটি নিরাপদ তা জানেন কিন্তু খেতে খেতে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলেন।
মানুষ জেনে বুঝে কেন অনিরাপদ খাবার খায়, কেন বেশি খায়, কেনই বা সারাক্ষণ খাই খাই করে সেটা একটা গভীর রহস্য। ‘খিদে’ নামের একটি ছড়া লিখেছিলেন লুত্ফর রহমান রিটন। ছড়াটি শুরু হয়েছে এভাবে, ‘আবদুল হাই/ করে খাই খাই/ এক্ষুণি খেয়ে বলে/ কিছু খাই নাই।’ আশপাশে একটু খুঁজে দেখুন, ছড়ার ‘আবদুল হাই’য়ের মতো অনেককেই পাবেন। এমনকি ‘আবদুল হাই’ হতে পারেন আপনি নিজেও। কিছুক্ষণ আগে খেয়েও আবার খিদে লাগে কেন?
আসলে খিদে হলো মানুষের বেসিক ইন্সটিংক্ট, প্রতিদিন পাবে, নিয়ম করেই পাবে। বিশ্বজোড়া কত খাবারের সমাহার, কত খাবার, কত বাহারি নাম, কত হোটেল, রেস্তোরাঁ, তাদের উর্দি পরা শেফ, লোভনীয় সব পদ। তাই নিয়ে কত বই, কত লেখা, কত রেসিপির বই, ইউটিউব ভিডিও, টিভি শো, রিয়েলিটি শো, সিনেমা।
রোজকার বেশাতিতে যা কেনা হয়, তার ৬০ কী ৭০ শতাংশই তো খাবার, মসলা, তেল, ঘি, মাখন। রাস্তায় চলতে বিলবোর্ডে সেলিব্রেটিদের ছবি, খাবারের বিজ্ঞাপন। কত্ত ডায়াটিসিয়ান, কী খাবেন, কতটা খাবেন নিয়ে কত আলাপ-আলোচনা, দিনের ক্যালরি ইনটেক মাপার জন্য মোবাইল অ্যাপ, বেশি খেলে কত ওষুধ, চিকিৎসা, ডাক্তার, হাসপাতাল। রাস্তার পাশে পাইস হোটেল থেকে রোলের দোকান, ঝালমুড়ি থেকে ফুচকা চুরমুর।
তারপরেও বিশ্ব জুড়ে খিদে, অসম্ভব খিদে। পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যার খিদে মেটে না, একপেট জল খেয়ে তাকিয়ে দেখে বিলবোর্ড, সেখানে মুরগির ঠ্যাং, এগ স্যান্ডুইচ বা টু মিনিটস নুুডলস, অভুক্ত বাচ্চা ভাবে দুই মিনিট কেন? সে তো দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে রাজি, কিন্তু তার পাতে আসে না সপসপে নুুডলস, যা তৈরি হয় দুই মিনিটেই। কোনো হিসাব নেই, কেউ এ হিসাব নেবে না, নিলেও লিখবে না, তবুও বলি আমাদের ঢাকায় তিন, চার বা পাঁচ তারা হোটেলের জমকালো রেস্তোরাঁ, রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ফাইন ডাইনিং রেস্তোরাঁয় এক দিনে, হ্যাঁ এক দিনে যত টাকার খাওয়া হয়, সেই টাকায় ঢাকার প্রত্যেকটা মানুষ, পেটপুরে ডালভাত খেতে পারবে, তাকানোর ইচ্ছেই হবে না ঐ অভিনেতার দিকে, যার হাতে ইনস্টান্ট কষা মাংসের বিজ্ঞাপন, যিনি বিলবোর্ডে ঝুলছেন, কারণ পেট ভরে গেলে ঘুম পায়।
সেই বিলবোর্ডকে প্রাসঙ্গিক রাখতে হলে ক্ষুধাকে বরকরার রাখতে হবে, চতুর্দিকে খিদেওলা মানুষ চাই, চাহিদা চাই, খাবারের চাহিদা, তাহলেই তো প্রথমে ভাতের স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন মাথায় গেঁথে গেলে ঘি ভাত পোলাও, বিরিয়ানি, কেক-পেস্ট্রি-কাবাব-পরোটা-বার্গার, আরো আরো আরো চাহিদা।
খিদের মর্ম বোঝাও, একবার বুঝলে সারা জীবন চাহিদা কাবার। শোনেন না, জুহু বিচে কেবল জল খেয়ে স্ট্রাগল করা অভিনেতার কথা? সে আর জীবনে খিদের ধার কাছ মাড়াতে চাইবে না, সে গরম ভাত থেকে পাস্তা, পিত্জা, বিরিয়ানিতে চলে গেছে। খিদে এমনই এক জিনিস, যা মানুষকে আপস শেখায়, আপসের প্রথম পাঠশালার নামই হলো ক্ষুধা। সেই হাঙ্গার, ক্ষুধা, খিদেকে নিয়ে দুই ধরনের ব্যবসা চলে সারা পৃথিবীতে। প্রথমটা হলো খাবার, খাদ্যদ্রব্য বিক্রি। দ্বিতীয়টা হলো খাবার পাইয়ে দেব, খাবারের জোগান দেব, দুই বেলা পেট পুরে খাবারে প্রতিশ্রুতির ব্যবসা, সোজা বাংলায় যাকে রাজনীতি বলে।
খিদে না থাকলে পটলা ব্যানার ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে না, খিদে না পেলে হারাধন মাইকে স্লোগান দিতে দিতে ক্লান্ত হবে না, খিদের কথা মনে না এলে আসলাম দল বেঁধে গিয়ে বিরোধী দলের কর্মীকে পেটাবে না, খিদে না পেলে মিতা, আয়েশা, কমলারা হাড়কাটা গলিতে সারি দিয়ে দাঁড়াবে না। খাবারের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক এটাই, ঠিক সেই কারণেই স্বাধীনতার পর থেকে, প্রত্যেক রাজনৈতিক দল, নেতা আর সংগঠন গরম ভাতের স্বপ্ন দেখিয়েছে, রুটি আর ডালের স্বপ্ন দেখিয়েছে, ‘সোনার বাংলা’ মানেই তো তিন বেলা খাবারের নিশ্চয়তা।
মজার ব্যাপার হলো, আমরা বাঙালিরা সব খাই। জল খাই, ঘুষ খাই, মদ খাই, গাঁজা খাই। এমনকি হুংকার ছাড়ি: খাইছি তোরে!
আমরা বাঙালিরা চা খাই, কফি খাই, শরবত খাই। আর, হ্যাঁ, যেটা ভাবছেন, সেই শরাবও খাই। কেবল তরল পদার্থ? বাঙালি সিগারেট খায়, বিড়ি খায়, চুরুট খায়। দুর্বল পেটরোগা মানুষ, যার কোনো কিছু খেলে হজম হয় না, সেও কিন্তু ‘গ্যাস খায়’। খাওয়ার কি শেষ আছে? কর্তাব্যক্তিরা সুযোগ পেলে অধস্তনের ‘চাকরি খায়’। বিপদে পড়ে ‘খাবি খায়’।
সর্বভুক হয়তো বলা যাবে না, তবে বাঙালি নিশ্চিতভাবেই বহুভুক, বিচিত্র ভুক। বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে খাওয়া-খাওয়ির বিচিত্র ফিরিস্তি। বাঙালির গাড়ি পেট্রোল খায়। ড্রাইভারদের জিগ্যেস করলে তারা বলে দেয়, কোন মডেলের গাড়ি কত তেল খায়।
আর খাবে নাই বা কেন? আর কোন ভাষায় কোন কবি খাওয়া নিয়ে সাড়ম্বরে কবিতা লিখেছেন?
‘খাই খাই কর কেন, এস বস আহারে,
খাওয়াব আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে’।
যারা বিশ্বসাহিত্যের ভূরিভোজের খোঁজখবর রাখেন, তারা বলতে পারবেন, এরকম ‘খাই খাই’ কবিতা অন্য কোনো ভাষাতে নেই।
বাংলার শ্রেষ্ঠ কবি তো কবিতা জীবন শুরু করেছিলেন খাওয়া দিয়ে।
‘আমসত্ত্ব দুধে ফেলি তাহাতে কদলী দলি,/ সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে,/ হাপুস হুপুস শব্দ চারিদিক নিস্তব্ধ/ পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।’
সুতরাং এই বাঙালি পরের মুখে ‘ঝাল খাবে’, মাস্টারের কাছে ‘কানমলা খাবে’, বন্ধুদের কাছে ‘ফাঁপর খাবে’, ভয়ে ‘থতমত খাবে’, এতে আর আশ্চর্য কী ?
একটু পিছিয়ে যদি অষ্টাদশ শতাব্দীতে যাওয়া যায়, সেখানে দেখা যায় কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের কাব্য অন্নদামঙ্গলে ঈশ্বরী পাটনি বর চাইলেন। কী বর? ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।’ বর চাওয়ার সময়েও খাওয়ার চিন্তা! তাহলে? এই বাঙালি ভুল করলে ‘বকা খাবে’ না, আর ভালোবেসে ‘চুমু খাবে’ না? ছেঁড়া চটি পরে ‘হোঁচট খাবে’ না? অতঃপর তারা যদি আয়েস করে পায়েস খায়, আর মাঠে গিয়ে ‘হাওয়া খায়’, কাজ করতে ‘হিমশিম খায়’, আর পা পিছলে ‘আছাড় খায়’, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু আছে কি?
যে ভাষায় কাব্যরসের সঙ্গে রসনার এত রসালো মাখামাখি, সে ভাষায় যদি কেউ চুরি করে ‘তাড়া খায়’, ভুল করে ‘গালি খায়’, সে খাওয়া কি খুব অস্বাভাবিক? তাই তো বাঙালি ‘ঘুষি খায়’, আবার ‘আদর খায়’। আকাশে ঘুড়ি ‘গোঁত্ খায়’, মাটিতে লাট্টু ‘পাক খায়’। অভাজন ‘গালি খায়’, আর সুদখোর মহাজন সুদ খায়। কিন্তু শুধু খেলেই তো হলো না, হজমও করতে হবে। তাই কেউ কেউ ‘কিল খেয়ে কিল হজম করে’। হাঁদাবোকা লোক ‘ভ্যাবাচ্যাকা খায়’।
বাংলা ভাষায় তাই ভাবের প্রকাশে খাওয়ার কোনো অভাব নেই। খাপে খাপে ‘খাপ খাওয়া’, তেলে জলে ‘মিশ খাওয়া’, ‘মাল খেয়ে’ ‘টাল খাওয়া’, বোকা বনে ‘ধোঁকা খাওয়া’, খাওয়া নিয়ে একেবারে ‘ঘোল খাওয়া’র ব্যবস্থা!
বাঙালিই সম্ভবত একমাত্র প্রজাতি যারা ব্রেকফাস্ট খাওয়ার সময়ে লাঞ্চের কথা ভাবে, আর লাঞ্চ খেতে খেতে চিন্তা করে ডিনারে কী খাবে। তাই তো বাঙালি ‘দুধও খায়’, আবার ‘তামাকও খায়’। কেউ কেউ চুপিচুপি ‘টাকা খায়’, পকেটমার ধরা পড়ে ‘মার খায়’, আবার ধর্মপালনের পরও ‘ঘুষ খায়’! ভিড়ের মধ্যে ‘ধাক্কা খায়’, ফুটবল মাঠে ‘গোল খায়’।
সুকুমার রায় ঐজন্য রায় দিয়ে দিয়েছেন, ‘এত খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা/ খাও তবে কাঁচকলা, খাও তবে ঘণ্টা।’