বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে বেড়েই চলেছে দুর্যোগ। প্রতি বছর কোনো না কোনো দুর্যোগ আঘাত করছে আমাদের প্রাণ-প্রকৃতিতে। এতে বিধ্বস্ত হচ্ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলো। একটি দুর্যোগের রেশ কাটতে না কাটতে আবারও নতুন কোনো মানবসৃষ্ট কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দিচ্ছে এসব জনপদে। ফলে সারা বছর নানা সংকটের মধ্য দিয়ে দিন পার করছে এ অঞ্চলের মানুষ। একটি সময় প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে তারা স্থানান্তর হচ্ছে; কিন্তু উপকূল জুড়ে আঘাত হানা এসব দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমে যায় পার্শ্ববর্তী সুন্দরবনের জন্য। তবে দেশের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার এই অন্যতম রক্ষাকবচ সুন্দরবন দিনে দিনে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। নানা কারণে সুন্দরবনের পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে। বিশেষ করে নির্বিচারে গাছ নিধন, বন্যপ্রাণী হত্যা, জলাশয়ে বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরাসহ নানাভাবে আজ বিপর্যস্ত আমাদের মাতৃস্নেহে আগলে রাখা সুন্দরবন। কোনোভাবেই যেন সুন্দরবনকে রক্ষা করা যাচ্ছে না অসৎ, লোভী আর প্রতারক শ্রেণির এসব মানুষের হাত থেকে।
বিশেষ করে উপকূলবর্তী যেসব অঞ্চল রয়েছে এসব জনপদের অধিকাংশ মানুষ জীবন-জীবিকার জন্য সরাসরি সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। কখনো তারা সুন্দরবনের মধ্যে মৌয়াল হয়ে মধু সংগ্রহ করতে যায়, কখনো জেলে হয়ে মাছ ধরতে যায় আবার কখনো কাঠুরিয়া হয়ে কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। অনেক সময় নিরাপত্তাহীনতার কারণে বনদস্যুদের হাতে আটক হয়ে মুক্তিপণ দিয়ে বেঁচে ফিরে আবার কখনো বন্যপ্রাণীর আক্রমণে জীবন চলে যায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বনদস্যুদের বড় বড় দল আত্মসমর্পণের ফলে কিছুটা হলেও শান্তি ফিরেছে সুন্দরবনে; কিন্তু আমাদের লোভী মানষিকতার কারণে আমরা নিজেরাই আমাদের কর্মসংস্থানের জায়গাগুলোকে ধ্বংস করে ফেলছি। প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে বনে প্রবেশের অনুমতি দেয় বন বিভাগ। বিভিন্ন শ্রেণিতে এসব পাশ নিয়ে তারা সুন্দরবনে প্রবেশ করে। তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে আগে থেকে বেশ সচেতনও হয়েছে বন কর্তৃপক্ষ। তবে তারা বৈধ অনুমতি নিয়ে বনে প্রবেশ করলেও ভেতরে ঢুকে অবৈধ কার্যক্রমে লিপ্ত হচ্ছে। বেশির ভাগ বনজীবীরা মধু সংগ্রহ কিংবা মাছ ধরার পাশ নিলেও তারা ভেতরে ঢুকে অবৈধভাবে কাঠ পাচার করছে। এতে দিনদিন সুন্দরবনে গাছের পরিমাণ কমছে। আর যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে। একটি সময় সুন্দরবনের জন্য ঘূর্ণিঝড়গুলো আমাদের উপকূলে খুব বেশি আঘাত আনতে পারতো না; কিন্তু বর্তমানে সুন্দরবনের গাছের পরিমাণ কমে যাওয়ায় ঘূর্ণিঝড় হলেই ক্ষয়ক্ষতি বেড়েছে কয়েক গুণ।
সম্প্রতি ২৮ ডিসেম্বর সুন্দরবনের দলদলিয়া খাল থেকে নৌকাভর্তি কাঠসহ তিন জনকে আটক করে বন বিভাগ পশ্চিম সুন্দরবন কর্তৃপক্ষ। সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী বন স্টেশন অফিসের সদস্যরা সুন্দরবনে অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে কাঠ পাচারের সময় এ তিন জনকে আটক করে। পরবর্তীকালে জানা যায়, বন বিভাগ থেকে কাঁকড়া ধরার অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে ঢুকে এসব মৎস্যজীবী অবৈধভাবে কাঠ কেটে নৌকা ভর্তি করে পাচার করছিল। অর্থাৎ তাদেরকে সরকারিভাবে সুন্দরবনে মাছ শিকার করার বৈধ অনুমতি দেওয়া হলেও তারা অতিলোভে সুন্দরবনের গাছ কেটে পাচার করছিল। বেশির ভাগ সময় গোলপাতার সংগ্রহের অনুমতি নিয়ে এ সমস্ত প্রতারক গোল পাতার ফাঁকে ফাঁকে গাছ কেটে সাজিয়ে আনে। প্রতিনিয়ত এমন শত শত ঘটনা ঘটছে আমাদের সুন্দরবন কেন্দ্রিক। কখনো সেটা প্রকাশ্যে আসছে আর কখনো চোখের আড়ালে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যদিও এই চোখে না দেখার পিছনে কিছু অসৎ বন বিভাগের কর্মকর্তার হাত রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। তবে যেটাই হোক না কেন—এ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জনপদকে বাঁচাতে চাইলে সুন্দরবন রক্ষার বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই। তাই নিজের বাঁচার স্বার্থে যদি নিজেরাই সচেতনতা অবলম্বন না করি, সুন্দরবন রক্ষায় জনমত গড়ে না তুলি, তাহলে এর খেসারত আমাদেরকে দিতে হবে। আর না হলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে অবশ্যই এর ফল ভোগ করতে হবে। এজন্য নিজেদের সচেতনতার পাশাপাশি বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরো বেশি আন্তরিক হতে হবে সুন্দরবনকে বাঁচানোর জন্য। শুধু আইন করে রাখলে তা কোনো কাজে আসবে না। এসব আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হবে। পাশাপাশি বনজীবীদের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।