বাবা বর্গাচাষি আর মা বাড়িতে গরু পালন করেন—এই নিয়ে টানাটানির সংসার মাসুদ রানাদের। অভাবকে সঙ্গী করেই চলে মাসুদ ও তাঁর বড় ভাই জাহিদ হাসানের পড়াশোনা। অন্যের জমিতে ঘর তুলে থাকা বাবা-মায়ের অর্থের অভাব ছিল, কিন্তু স্বপ্ন দেখায় কোনো বাধা ছিল না।
তাঁরা স্বপ্ন দেখতেন, যত অভাবই হোক না কেন, দুই ছেলের পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন। তাঁদের মানুষের মতো মানুষ করবেন। মা–বাবার সেই স্বপ্ন এখন পূরণ হয়েছে। ছোট ছেলে মাসুদ রানা চিকিৎসক হয়েছেন। বর্তমানে তিনি কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন।
মাসুদ রানার বাড়ি নীলফামারীর ডোমার উপজেলায়। দুই ভাই শুরুতে যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করেন, তখন পড়াশোনার খরচ তেমন ছিল না। কিন্তু তাঁরা যত ওপরের শ্রেণিতে উঠছিলেন, খরচের কারণে ততই যেন পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া কষ্টকর হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বাবা-মা তো তাঁদের ছোটবেলাতেই স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন—যে করেই হোক পড়াশোনা শেষ করতে হবে, মানুষের মতো মানুষ হতে হবে। অর্থ তেমন নেই, আছে কেবল আশীর্বাদ। সেই আশীর্বাদ নিয়েই খেয়ে না-খেয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন দুই ভাই। কঠোর পরিশ্রম করে ২০০৮ সালে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পান মাসুদ।মাসুদের এই ফলে মা–বাবা, ভাইসহ এলাকাবাসী সবাই খুশি। কিন্তু এতে আনন্দের চেয়েও দুশ্চিন্তা বেড়ে যায় মাসুদের। এইচএসসিতে পড়ার খরচ আসবে কোত্থেকে—এই ভাবনায় অস্থির হয়ে পড়েন তিনি। ঠিক এই সময়ে প্রথম আলোয় অদম্য মেধাবী মাসুদ রানার সংগ্রামের গল্প প্রকাশিত হয়। এরপর মাসুদ ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তির জন্য নির্বাচিত হন। সেই অর্থে এইচএসসিতে পড়াশোনা শুরু করেন। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ২০১০
এই শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে এইচএসসি পাসের পর ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান মাসুদ। রসায়ন বিভাগে ভর্তি হয়ে ক্লাস শুরু করেন। কিন্তু মা-বাবা চেয়েছিলেন ছেলে চিকিৎসক হবে, গ্রামের সাধারণ মানুষের সেবা করবে। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনায় ঠিক মন বসাতে পারছিলেন না মাসুদ। তাই দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। এবার লক্ষ্য একটাই, মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে হবে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়ে যান তিনি। রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএসে ভর্তি হয়ে সাফল্যের সঙ্গে পাস করে বেরিয়ে আসেন মাসুদ।
এরপর ৩৯তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে কিশোরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন মাসুদ রানা। এরই মধ্যে তাঁর বড় ভাই জাহিদ হাসান পড়াশোনা শেষ করে রংপুরে একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে মেডিকেল প্রমোশন অফিসার হিসেবে কাজ করছেন। দুই ভাইয়ের আয়ে এখন পরিবারে সচ্ছলতা ফিরতে শুরু করেছে। স্বপ্ন পূরণ হওয়ায় হাসি ফুটে উঠেছে মা-বাবার মুখেও।
মা-বাবার কথা রাখতে সাধারণ মানুষকে সেবা দেওয়া শুরু করেছেন মাসুদ। কর্মস্থল থেকে তিনি যখন নীলফামারীর ডোমারে গ্রামের বাড়িতে যান তখন স্থানীয় লোকজন নিজেদের শারীরিক সমস্যার কথা জানাতে তাঁর কাছে ছুটে আসেন। মাসুদও সাধ্যমতো তাঁদের সহযোগিতা করেন।
মাসুদ রানা বলেন, ‘পরিচিতরা আমার কাছে এসে তাঁদের সমস্যার কথা বলেন। তাঁদের চিকিৎসাসেবা দিই। এতে এলাকাবাসীর যে দোয়া পাই, তা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।’
এখন উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশের মানুষকে আরও উন্নতমানের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন মাসুদ। তাঁর কথায়, ‘আমাদের মা-বাবা নিজেরা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, খেয়ে না–খেয়ে থেকেছেন শুধু আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য। তাই তাঁদের জন্য হলেও জীবনে এগিয়ে যে
প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদম্য মেধাবী’ শিক্ষাবৃত্তি সারা দেশের গরিব, মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য খুলে দিয়েছে সম্ভাবনার দুয়ার। অদম্য মেধাবীদের একেকটি গল্প অন্যদের জন্য হয়ে উঠেছে অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস।
প্রথম আলো ২০০৭ সাল থেকেই এই শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে আসছে। তবে ট্রাস্ট গঠনের পর থেকে এটি নিয়মিতভাবে দেওয়া হচ্ছে। ২০১০ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে এর পরিধি বাড়ে।
প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে মাসুদ রানা ছাড়াও চিকিৎসক হয়েছেন মো. বিপুল মিয়া, নাজমিন বেগম, আওলাদ হোসেন, মোহাম্মদ শামসুল হক, মো. আবু হোসাইন, নিলয় কুন্ডু, গৌরব মজুমদার, মারিয়াম খানম শিমুল।
বিপুল মিয়া ৩৯তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আবাসিক মেডিকেল অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে কর্মরত আছেন। সিলেটে ইবনে সিনা হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ করছেন নাজমিন বেগম, দশম শ্রেণিতে উঠতে না উঠতেই যাঁর বিয়ে হয়েছিল। আর বিয়ের ১৮ দিনের মাথায় শ্বশুরবাড়ির লোকের অবহেলার প্রতিবাদ করে চলে এসেছিলেন তিনি। রাতে পড়াশোনা করলে কেরোসিন তেল ফুরিয়ে যাবে, তাই আওলাদ তাঁর পড়াশোনা করতেন দিনের বেলায়। আওলাদ এখন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জেনারেল
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে বর্তমানে মাউন্ট এডোরা হসপিটালে মেডিসিন বিভাগে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ করছেন মোহাম্মদ শামসুল হক। বাবার মৃত্যুর পর আবু হোসাইনকে অন্যের জমিতে কাজ করতে হয়েছে। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী আবু হোসাইন সাতক্ষীরা ইসলামী ব্যাংক কমিউনিটি হাসপাতালে আবাসিক মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ করছেন।
নিলয় কুন্ডু সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস শেষে ৩৯তম বিসিএসে সহকারী ডেন্টাল সার্জন পদে গৌরনদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাজ করছেন। ইতিমধ্যে এফসিপিএসও শুরু করেছেন। গৌরব মজুমদার বরিশাল মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস শেষ করে গৌরনদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাজ করছেন। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করেছেন অদম্য মেধাবী মারিয়াম খানম শিমুল।
প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে বর্তমানে আরও ১৪ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন মেডিকেলে অধ্যয়নরত আছেন।
ব্র্যাক ব্যাংক ও অন্য দাতাদের সহযোগিতায় এখন পর্যন্ত মোট ১ হাজার ১৪৩ জন অদম্য মেধাবী শিক্ষার্থী সহায়তা পেয়েছেন। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকের সহায়তায় বৃত্তি পেয়েছেন মোট ৯০৭ জন। ব্র্যাক ব্যাংকের পাশাপাশি অন্যান্য দাতা সংস্থা ও ব্যক্তির সহায়তায় এই তহবিলের মাধ্যমে বৃত্তি পেয়েছেন আরও ২৩৬ জন। বর্তমানে বৃত্তি পাচ্ছেন ২৫১ জন।
অদম্য মেধাবী ছাড়াও প্রথম আলো ট্রাস্ট আরও কিছু প্রকল্প পরিচালনা করে থাকে। এর একটি হলো ‘অদ্বিতীয়া’। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ২০১২ সাল থেকে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন ও প্রথম আলো ‘ফার্স্ট ফিমেল ইন দ্য ফ্যামিলি স্কলারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ নামে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া শুরু করে। প্রতিবছর পরিবারের প্রথম নারী অথচ অসচ্ছল, যিনি উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজ গঠনে আগ্রহী, এ রকম ১০ জনকে ট্রান্সকম গ্রুপের সহায়তায় এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে এ শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া শুরু করে প্রথম আলো ট্রাস্ট। ট্রান্সকমের সহায়তায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪২ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছেন।
২০১৭ সাল থেকে আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড এই শিক্ষাবৃত্তির দায়িত্ব নেয়। নতুনভাবে নামকরণ করা হয় ‘অদ্বিতীয়া’। আইডিএলসি ফাইন্যান্সের সহায়তায় ৪৬ জনসহ এ পর্যন্ত মোট ৮৮ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছেন। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনও তাঁ
প্রথম আলো ট্রাস্টের আরেকটি উদ্যোগের নাম ‘আলোর পাঠশালা’। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় যেখানে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি, এ রকম অবহেলিত কয়েকটি এলাকায় শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে এমন উদ্যোগ।
সামিট গ্রুপের সহযোগিতায় প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় এসব দুর্গম এলাকায় ছয়টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কুড়িগ্রামে ১টি, রাজশাহীতে ২টি, ভোলায় ১টি, নওগাঁয় ১টি ও টেকনাফে ১টি করে মোট ৬টি স্কুল পরিচালনা করছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। ছয়টি স্কুলে মোট ১ হাজার ২০ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।
এ ছাড়া প্রথম আলো ট্রাস্টের অন্য উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে মাদকবিরোধী আন্দোলন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ তহবিল পরিচালনা, অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য সহায়ক তহবিল, রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনের জন্য মেরিল–প্রথম আলো সাভার সহায়তা তহবিল, গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সহায়তায় নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলায় ‘সাদত স্মৃতি পল্লী’। এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদের সহযোগিতায় প্রথম আলো ট্রাস্ট প্রকল্পটি পরিচালনা করছে।