বহু জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত ১০ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ পেয়েছে প্রিন্স হ্যারির স্মৃতিকথামূলক বই ‘স্পেয়ার’। বাজারে আসার আগেই বইটি নিয়ে বিশ্বব্যাপী বেশ হইচই পড়ে যায়। এর পেছনে অবশ্য কারণও আছে। বইটিতে ব্রিটিশ রাজপরিবারের বহু অজানা অধ্যায় তুলে ধরেছেন লেখক প্রিন্স হ্যারি। ফলে স্বভাবতই চারিদিকে সাড়া ফেলে দেয় ‘স্পেয়ার’। যুক্তরাজ্যে বইটি প্রথম প্রকাশ্যে আনে দেশটির প্রথম সারির সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান। এ নিয়ে প্রথম নিবন্ধেই প্রকাশ করা হয় হ্যারি-উইলিয়াম দুই ভাইয়ের মারামারির ঘটনা! ঘটনা অনুযায়ী, হ্যারিকে আঘাত করে নিচে ফেলে দেন ভাই উইলিয়াম। এ ঘটনা ছোটখাটো ছিল না মোটেই। কেননা, ছোটখাটো ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে দুই সহোদরের মারামারিতে!
উল্লেখ করতে হয়, হ্যারির এই বহুল প্রতীক্ষিত আত্মজীবনী তথা ‘স্পেয়ার’ শীতকালের গরম পিঠার মতো বিক্রি হচ্ছে যুক্তরাজ্যে। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশের পর লন্ডনে বইয়ের দোকানে রীতিমতো ভিড় লেগে যায় উত্সাহী পাঠকদের। বইটির এতটাই কাটতি যে, তাদের সামাল দিতে মধ্যরাত পর্যন্ত খোলা রাখতে হচ্ছে দোকান! মূলত প্রকাশিত হওয়ার আগেই বইটি নিয়ে একের পর এক চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে আসায় সবার তীব্র আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে ‘স্পেয়ার’। কীভাবে হ্যারি নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন, অভিনেত্রী মেগান ম্যার্কেলকে বিয়ের পর তার ভাই উইলিয়াম কীভাবে তাকে মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছিলেন, পিতৃপরিচয় নিয়ে তার বাবা তৃতীয় চার্লস কী ‘তেতো স্বাদের’ কৌতুক করেছিলেন, ১৯৯৭ সালে তার মা প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুতে পুরো দুনিয়া শোকাহত হলেও তিনি কেন মাত্র একবারই কেঁদেছিলেন ইত্যাদি বিষয় আগ্রহের জন্ম দেয় পাঠকদের মধ্যে। যে কারণে বইটির প্রতি আকর্ষণ ছিল প্রায় সবার মধ্যে। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী ১৬টি ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে বইটি। গত এক দশকে সবচেয়ে বেশি প্রি-অর্ডার হওয়া বইয়ের তালিকায়ও নাম লিখিয়েছে ‘স্পেয়ার’।
আসলে ‘স্পেয়ার’ এমন এক বই, যা একজন ব্যক্তির (প্রিন্স হ্যারি) দুঃখময় জীবনের নানা অজানা অধ্যায় তুলে ধরেছে। এক ব্যক্তি পদে পদে কতটা আঘাত পেয়েছেন, আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তা-ই লেখা হয়েছে বইটিতে। ‘স্পেয়ার’ প্রিন্স হ্যারির স্মৃতিকথার এমন এক কেন্দ্রীয় কাহিনি, যা একজন মানুষের জীবনের ট্র্যাজেডিকে পাঠকের সামনে তুলে ধরে অনেকটা খোলাখুলিভাবে। যার মাধ্যমে দেখা যায়, নিজের জীবনের ওপর কখনোই সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল না হ্যারির। প্রচুর সুযোগ-সুবিধার মধ্যে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও, প্রাচুর্যের মধ্যে জীবন কাটিয়েও প্রিন্স হ্যারিকে শিকার হতে হয়েছে নানা স্পর্শকাতর পরিস্থিতির। খুব ছোট্ট বয়স থেকেই উপেক্ষা করা হয়েছে হ্যারিকে। পরিস্থিতি এমন ছিল, বড় ভাই উইলিয়ামের জীবনে বাজে কিছু ঘটলেই (মারা গেলে) কেবল হ্যারিকে মূল্যায়ন করা হবে। অর্থাৎ, হ্যারিকে বিবেচনা করা হতো উইলিয়ামের বিকল্প হিসেবে, তথা বড় ভাই যতকাল জীবিত থাকবেন, সেই অবধি কোনো দরকার নেই ছোট ভাই হ্যারির! হ্যারির কথায় জানা যায়, তার সঙ্গে পরিবারের কোনো সদস্যই কাঙ্ক্ষিত আচরণ করতেন না—কী অদ্ভুত কথা!
বহুদিন আগে থেকেই রাজপরিবার কিংবা ব্রিটিশ প্রেসের সঙ্গে হ্যারির সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। এজন্য হ্যারির কথা বলার সময় প্রায় সময়ই ততটা আগ্রহ-উত্সাহ দেখায় না মিডিয়াগুলো। এমনকি তার সম্পর্কে যা-তা কথাবার্তা বলা হয়েছে বহু বার। বিদ্বেষপূর্ণ প্রশ্নবাণ থেকে বাদ পড়েননি হ্যারির স্ত্রী মেগান ম্যার্কেলও। নানা বর্ণবাদী কথাবার্তা বলা হয় মেগানকে নিয়ে। ‘স্পেয়ার’-এ এসব বেশ ভালোভাবেই নথিভুক্ত করেছেন হ্যারি। তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে আলোচনার শীর্ষ হয়ে উঠেছে হ্যারির পুরুষত্বকে (যোগ্যতা) খাঁটো করে দেখার ঘটনা। বড় ভাই উইলিয়ামের সঙ্গে অযাচিতভাবে তার তুলনা করে কীভাবে তাকে একটু একটু করে মাঠের বাইরে ছুড়ে দেওয়া হয়, তা অবাক ও ব্যথিত করেছে সবাইকে! মনে রাখতে হবে, প্রিন্স হ্যারি দীর্ঘদিন সামরিক অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কাজেই পুরুষত্ব নিয়ে খোঁচা দেওয়া তাকে বিক্ষুব্ধ করবে স্বভাবিকভাবেই। রয়্যাল পরিবারের সদস্য হয়েও যথারীতি চাকরির দায়িত্ব পালন করার জন্য যেখানে হ্যারিকে নিয়ে গর্ব করার কথা, সেখানে উলটো তাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে—এ ঘটনা দুঃখজনকই বটে।
বংশপরম্পরায় রাজপরিবারের অনেকেই এ ধরনের নানা দায়িত্ব পালন করার জন্য উচ্চ প্রশংসায় ভূষিত হন। কিন্তু হ্যারির বেলায় ঘটেনি তেমনটা। তাই এ নিয়ে তিনি অভিযোগ করতেই পারেন। হ্যারির এ ধরনের অভিযোগের বর্ণনা মেয়েলি ঘরানার ও দুর্বল মানসিকতার বলে মনে হতে পারে। কিন্তু হ্যারির জায়গায় যে কেউ থাকলে তো একই কাজ করবে। সত্যি বলতে, ‘প্রাতিষ্ঠানিক হ্যারি’র থেকে ‘স্বামী হ্যারি’ হিসেবে তাকে অনেক বেশি প্রাণবন্ত বলে মনে হয়। অর্থাৎ, হ্যারির যোগ্যতা কিংবা অবদান নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই।
রক্ষণশীল রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আজকের তরুণেরা আর ‘প্রকৃত পুরুষ’ নয়! কয়েক বছর আগে ঠিক একই ধরনের কথা বলা হয়েছিল প্রভাবশালী উইল উইট ডেনভার ইউনিভার্সিটির এক আলোচনায়। ‘মেক মেন ম্যাসকুলিন অ্যাগেইন’ শিরোনামে এক আলোচনায় যুক্তি দেখিয়ে বলা হয়েছিল, ‘পুরুষদের আর পুরুষালি না থাকা’ বিশ্বে গভীর সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করছে। মার্কিন রিপাবলিকান সিনেটর জোশ হাওলির প্রকাশিতব্য ‘ম্যানহুড :হোয়াট আমেরিকা নিডস’ বইয়ে আমেরিকান পুরুষদের ‘স্বামী, পিতা ও নাগরিক’ হিসেবে ঈশ্বর প্রদত্ত দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। যুক্তরাজ্যের আলোচিত ডানপন্থি রাজনৈতিক কর্মী লরেন্স ফক্সকে ব্যঙ্গ করে বলা হয়েছিল, পুরুষেরা এখন আর ‘কঠিন’ নয়। এরপর এক টুইটে লরেন্স বলেন, ‘খারাপ সময় কঠিন মানুষ তৈরি করে। সেই কঠিন মানুষ আবার ভালো সময় তৈরি করে! এবং সেই ভালো সময় তৈরি করে নরম পুরুষ। আমরা এখন খারাপ সময়ে আছি।’ যা হোক, ‘স্পেয়ার’-এ হ্যারির খোলাখুলিভাবে কথা বলার কারণে বহু আলোচনা-সমালোচনা করতে পারেন বহু বিশ্লেষক। কিন্তু সত্যি বলতে, হ্যারির সঙ্গে যে ভালো কিছু ঘটেনি—এই দাবি অস্বীকার করতে পারবেন না কেউই।
‘স্পেয়ার’ গ্রন্থে হ্যারি ব্রিটেনের একটি সংবাদপত্রে আঁকা একটি কার্টুনের কথা স্মরণ করেছেন। সে ধরনের বহু কার্টুনে তাকে ও তার স্ত্রীকে যারপরনাই হেয় করা হয়। ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে হ্যারি ও তার স্ত্রীকে ব্যঙ্গ করা হয় বহুভাবে। যা হোক, স্পেয়ার প্রকাশের প্রাক্কালে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করে জানানো হয়, প্রিন্স হ্যারিকে সাইকোথেরাপি পেয়ে বসেছে! এই সাইকোথেরাপি থিওরি অনুযায়ী, এক ব্যক্তি নিজেকে ‘শিকার’ হিসেবে উপস্থাপন করে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও এ নিয়ে বহু কথা বলা হচ্ছে যদিও, কিন্তু তা নিতান্তই অবান্তর। বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেদের বানানো গল্প চালাচালি চলছে বটে, কিন্তু ‘স্পেয়ার’ চলছে দাপটের সঙ্গে। এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে দ্রুত বিক্রি হওয়া ননফিকশন বই হয়ে উঠেছে স্পেয়ার। স্পেয়ার বাস্তবিক অর্থে এমন এক গল্পকে সামনে এনেছে, যা অপরিমেয় বিশেষাধিকারী এক ব্যক্তির বহু অজানা তথ্যের সঙ্গে পাঠকসমাজকে পরিচয় করিয়ে দেয়। হ্যাঁ, বইটিতে এমন সব কথাবার্তা আছে, যা ব্রিটিশ সমাজের মানুষকে নাড়া দিয়ে যায়। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হ্যারি নিজেই বলেছেন এমন কথা—‘পরিবারকে ছাড় দিতেই নিজের স্মৃতিকথায় সব লিখিনি। সব লিখলে বাবা ও ভাই আমাকে কখনোই ক্ষমা করতে পারতেন না। আমার কাছে আরো একটি বই লেখার মতো পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত রয়েছে।’
হ্যারির এই বই কোনোভাবে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত মিশন কি না—এমন এক প্রশ্নের জবাবে হ্যারি বলেন, ‘এটি রাজতন্ত্র ধ্বংসের কোনো কিছু নয়, বরং এটি নিজেদের কবল থেকে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা মাত্র। আমি জানি, অনেক কথা ফাঁস করায় অনেক লোকই আমাকে দোষী বলে সাব্যস্ত করবে।’ হ্যারির দাবি, তার উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ রাজপরিবারের সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্ক ছিন্ন করানো। একই সঙ্গে পিতা ও ভাইকে নিজের জীবনে ফিরে পাওয়া! তবে প্রকৃত ঘটনা কী, তা সময়ই বলে দেবে।