সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের জীবনকে সহজ ও সুন্দর করেছে। একই সঙ্গে এই প্রযুক্তির অপব্যবহার মানুষের জীবনকে করেছে বিপথগামীও। প্রযুক্তির অসৎ ব্যবহারে অনেকের সম্ভাবনাময়ী জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে, এমন উদাহরণও কম নেই। বিশেষ করে বর্তমান বিশ্বে নব-আবিষ্কৃত ভিডিও এডিটিং প্রযুক্তি ‘ডিপফেক’ মুহূর্তেই যে কারো সম্ভাবনাময় জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে। অস্বীকার করার উপায় নেই, ডিপফেক একটি বড় আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমান সময়ে। অত্যাধুনিক এ ভিডিও এডিটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে কোনো ব্যক্তির ছবি ব্যবহার করে (হতে পারে ব্যক্তির ঐ ছবি তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে) মুহূর্তেই তৈরি করে ফেলা হচ্ছে পর্নোগ্রাফি—কী সাংঘাতিক বিষয়!।
মূলত ডিপফেকের প্রধান শিকার নারীরা। বোস্টন ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক ড্যানিয়েল সিট্র বলেছেন, ‘ডিপফেক প্রযুক্তি নারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে।’ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ১ লাখের বেশি নারীর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে পর্নোগ্রাফি বানানো হয়েছে। এরপর তা ছড়িয়ে দেওয়া হয় পর্নোগ্রাফিভিত্তিক বিভিন্ন ওয়েবসাইটে, এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কী অবাক করার বিষয়!
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ আই ফারম ডিপট্রেস সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে অনলাইনে ১৫ হাজার ডিপফেক ভিডিও খুঁজে পেয়েছে, যার মধ্যে ৯৬ শতাংশ ভিডিও পর্নোগ্রাফির আওতাভুক্ত। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, ডিপফেক ভিডিও ভয়াবহ হারে ছড়িয়ে পড়ছে। ডিপফেক ভিডিওতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি ব্যবহার করে এমনভাবে ভিডিওচিত্র তৈরি করা হয়, যা দেখে বোঝার উপায় থাকে না—ভিডিওটি আসল নাকি নকল।
২০০৯ সালে ডিপনুড নামে একটি ডেস্কটপ অ্যাপ্লিকেশন চালু হয়েছিল, যার মাধ্যমে নারীর দেহ থেকে কাপড় সরিয়ে ফেলা হতো এবং মেসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেওয়া হতো। পরবর্তী সময়ে এর ভয়াবহ প্রভাব প্রত্যক্ষ করে কর্তৃপক্ষ একে অনলাইন থেকে সরিয়ে নেয়। প্রথম দিকে এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেলিব্রেটিদের পর্নোগ্রাফি তৈরি করা হলেও ইদানীং সাধারণ মানুষের ছবি ব্যবহার করে অশ্লীল ভিডিও তৈরি করার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা একজন নির্দোষ সাধারণ মানুষের জীবনে ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনতে পারে। এজাতীয় ভিডিওর মাধ্যমে একজন মানুষের জীবন মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়। এমন জঘন্য অন্যায়ের স্বীকার হওয়ার ফলে ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে তার শিক্ষাজীবন, পেশাজীবন তথা ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতিবাচকতা ছড়িয়ে পড়ে। মনে রাখতে হবে, যারা এগুলো করছেন, তারা অনেক ক্ষেত্রে শুধু বিনোদনের জন্য এ ধরনের হীন কাজ করে থাকেন! সচেতনতার অভাবে কেবল বিনোদন লাভের জন্য প্রযুক্তির অপব্যবহার করে নিরপরাধ একজন মানুষের জীবন ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। সারা জীবন ধরে অর্জন করা অর্থ, যশ, প্রতিপত্তি এক নিমেষেই ধুলোয় মিলিয়ে দিতে সক্ষম এ ধরনের মাত্র একটি ভিডিওই। এই ক্ষতির দিকটি বিবেচনা করে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র ডিপফেক ভিডিও রোধে কাজ করছে, যা অত্যন্ত সময়োপযোগী।
আমাদের দেশের সমাজবাস্তবতা দিয়ে বিবেচনা করলে যে কোনো নারীর জীবন ধ্বংস করে দিতে এমন একটি ভিডিওই যথেষ্ট। তাই এ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার শুরুর আগেই ডিপফেক সম্পর্কে বিশেষ সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মের বড় একটি অংশ তাদের পারিপার্শ্বিক জটিলতা সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে না পারায় হতাশায় বুঁদ হয়ে আছে। এ হতাশা থেকে প্রায়ই আত্মহত্যার পথে হাঁটছে অনেকেই। এমন একটি সময় ডিপফেক প্রযুক্তির বিস্তৃতি আমাদের তরুণ সমাজকে ব্যাপকভাবে বিপথগামী করার আশঙ্কা রয়েছে। তাই দেশে ডিপফেক প্রযুক্তির ব্যবহার ও বিস্তৃতি হ্রাসে এখনই যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।