ভারত এখন বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমদানি ক্ষেত্র। ভারত থেকে আমরা যেসব পণ্য আমদানি করি, গত কয়েক বছরে তার কম্পোজিশনে বড় পরিবর্তন এসেছে। শুরুর দিকে আমাদের অতিমাত্রায় নির্ভরতা ছিল খাদ্যপণ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ওপর। বর্তমানে কাঁচামাল ও শিল্পায়নে প্রয়োজনীয় মূলধনি যন্ত্রের মতো পণ্যের দিকে আমদানিটা স্থানান্তরিত হয়েছে। তার অর্থ হলো ভারত থেকে আমরা যা আমদানি করছি তার বড় অংশ রপ্তানি খাতে কাঁচামাল হিসেবে কিংবা যন্ত্রপাতি হিসেবে ব্যবহার করতে পারছি এবং দেশীয় শিল্পকারখানায় তার ব্যবহার দেখছি। ভারত থেকে আমদানির ক্ষেত্রে এই যে কম্পোজিশনাল শিফট, সেটি ইতিবাচক।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিসরে এটিকে আমরা বেশ একটা ইতিবাচক পরিবর্তন হিসেবে দেখব। কারণ ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করা অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে এ ধরনের গাঠনিক/উপাদানগত রূপান্তরটা দেখা যাচ্ছে না। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে কিছুটা হয়েছে, নেপাল-ভুটানের ক্ষেত্রে একদমই নয়। নেপাল ও ভুটানের ভারতের ওপর একটা অতিমাত্রায় নির্ভরতা আছে একেবারে বেসিক কমোডিটিজ নিয়ে। সেদিক থেকে বাংলাদেশ ভারত থেকে আমদানির ক্ষেত্রে নিজের সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। সক্ষমতাকে অনেকের তুলনায় যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পেরেছে।
রপ্তানিক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করছি, বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি বেড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ভারতে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যে, ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি করার আরো অনেক বেশি সক্ষমতা আছে। আরো সম্ভাবনাও আছে। এক্ষেত্রে কিছু শুল্ক ও অশুল্ক বাধা আছে, এগুলোকে যদি দূর করা যায়, তাহলে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি বেশ কয়েক গুণ বাড়বে। তবে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় শুল্ক বাধা অবশ্য তেমন নেই, যেহেতু উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ২০১১ সাল থেকে ভারত শুল্ক সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে অশুল্ক বাধার মুখোমুখি হয়েছেন বলে রপ্তানিকারকরা অভিযোগ করেছেন। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে প্রস্তাবিত কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট বা সেপা নামে একটি নতুন চুক্তির কথা ভাবা হচ্ছে, যা স্বাক্ষর হলে দুই দেশের বাণিজ্য কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। চুক্তির প্রথম বছরেই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়বে ৫ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার। চুক্তিটি দুই দেশের মধ্যে একটি ‘উইন-উইন সিচুয়েশন’ (উভয় পক্ষই লাভবান হয় এমন পরিস্থিতি) তৈরি করতে সক্ষম হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে এরকম একটি চুক্তির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে পরিচালিত প্রাথমিক সমীক্ষায় এ দাবি করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সমীক্ষাটি পরিচালনা করে বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট (বিএফটিআই)। একই সমীক্ষার আওতায় সেপা চুক্তির সম্ভাব্যতা ইস্যুতে ‘সেবা ও বিনিয়োগ খাত’ বিষয়ক ভিন্ন চ্যাপ্টার নিয়েও কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে চূড়ান্ত হওয়ার আগে এর কোনো ফলাফল প্রকাশ করা হবে না বলে জানিয়েছে বিএফটিআই দায়িত্বশীল সূত্রগুলো। অন্যদিকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও অনুরূপ সমীক্ষা পরিচালনা করছে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ফরেন ট্রেড (আইআইএফটি)।
কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা) এমন এক চুক্তি, যার লক্ষ্য বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন বাড়ানোর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়াতে গেলে আমদানি-রপ্তানির প্রশ্ন আসবে। এক্ষেত্রে ব্যবসা সহজ করতে বন্দর ও সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। এর পাশাপাশি শুল্ক-অশুল্ক বাধা দূর করতে পদক্ষেপের প্রয়োজন হবে। এরকম চুক্তি থাকলে চাইলেই কেউ চুক্তির তালিকায় থাকা পণ্যে অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক বসিয়ে বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে ভারতে ১২৭ কোটি ৯৬ লাখ ৭০ হাজার (প্রায় ১.২৮ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। বিএফটিআইয়ের প্রাথমিক সমীক্ষায় দাবি করা হয়, ভারতের সঙ্গে সেপা চুক্তি হলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যসংক্রান্ত বাধাগুলো দূর হবে। তখন যৌথ টেস্টিং সার্ভিস, ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু হবে। এতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে বর্তমান (প্রায় ১.২৮ বিলিয়ন ডলার) রপ্তানি আয়ের বাইরে আরো ৩ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। সমীক্ষায় আরো বলা হয়, সেপা চুক্তি স্বাক্ষরের পর বাণিজ্য বাধাগুলো দূর হয়ে গেলে পালটে যাবে বাংলাদেশের আমদানি চিত্রও। ভারতের বেশির ভাগ পণ্য ও সেবা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে সহনীয় বলে এবং পরিবহন খরচ কম ও সময় সাশ্রয়ের কারণে বাংলাদেশি আমদানিকারকরা একই পণ্যের জন্য দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোর বদলে ভারতমুখী হবে। তখন ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ বাড়বে। সেক্ষেত্রে বর্তমান ৭ বিলিয়ন ডলারের আমদানি আরো ৪ থেকে ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেড়ে যাবে। সমীক্ষায় দাবি করা হয়, দুই দেশের আমদানি-রপ্তানির যে ঘাটতি, তা পণ্য ও সেবা বৈচিত্র্যের সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে ধীরে ধীরে কমানো সম্ভব। চলতি বছর মার্চে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুই দেশের বাণিজ্যসচিব পর্যায়ের নিয়মিত বৈঠকে বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে সেপা স্বাক্ষরের বিষয়ে প্রথম ঐকমত্য দেখা যায়। পরে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনায় সবুজ সংকেত মেলে। এরপরই সেপা স্বাক্ষরের বিষয়ে ভারত-বাংলাদেশ একযোগে কাজ শুরু করে। এর পাঁচ মাসের মাথায় ভারতের সঙ্গে সেপা স্বাক্ষরের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা খোঁজার প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষ করল বাংলাদেশ। এর ওপর এখন খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অংশীজনদের (স্টেকহোল্ডার) মতামত নেওয়া হচ্ছে।
গত ২৬ মাচ/২২ ইং বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পায়। ২০২৬ সালের পর বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ পরিপূর্ণ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবে। এর আগেই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকে বিভিন্ন ধরনের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে হবে, যার মধ্যে আছে প্রেফারেন্সিয়াল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (পিটিএ) ও ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (এফটিএ)। চুক্তি করতে হবে আঞ্চলিক জোটগুলোর (আরটিএ) সঙ্গেও। এর বাইরে বৃহৎ বাণিজ্যকারী দেশগুলোর সঙ্গে এরকম সেপা চুক্তি স্বাক্ষরের প্রয়োজন হবে। ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং দক্ষিণ এশিয়ার স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ভারতের স্পর্শকাতর পণ্যতালিকা ৪৮০টি থেকে কমিয়ে মাত্র ২৫টিতে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেন। এর মধ্য দিয়ে কার্যত বাংলাদেশকে ভারতের বাজারে প্রায় শতভাগ শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দেওয়া হয়। প্রতিবেশী হওয়ায় বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় ভারতে কম খরচে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি হওয়ার কথা। স্বাভাবিক নিয়মে এই বিপুল পরিমাণ শুল্ক সুবিধায় বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ার কথা। এই সম্ভাবনা দেখে ২০১৮ সালের এক গবেষণায় বিশ্বব্যাংক বলেছিল, বাণিজ্য সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগানো গেলে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত উন্নীত হতে পারে। দুই দেশের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ গত ১০ বছরে গড়ে ৮ বিলিয়ন ডলারের মতো ছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে ১০৯ কোটি ৬৩ লাখ ৮০ হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। আর বিপরীতে আমদানি করা হয় ৫৭৯ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের পণ্য। এ হিসাবে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪৬৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭৬৫ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ। বিপরীতে রপ্তানি করেছিল ১২৫ কোটি ডলারের পণ্য। বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৬৪০ কোটি ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল ৫৪৫ কোটি ২৯ হাজার ডলার। রপ্তানির অঙ্ক ছিল ৬৯ লাখ ডলার। বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৪৭৬ কোটি ডলার।
এর আগে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো দেশের সেপা চুক্তি সম্পাদিত না হলেও ভারত ইতিমধ্যে সাতটি দেশের সঙ্গে এ চুক্তি করেছে। ১৯৯৮ সালে ভারত শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সেপা চুক্তি করে। এরপর সিঙ্গাপুরের সঙ্গে ২০০৫ সালে, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ২০০৯ সালে, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে ২০১০-১১ সালে এবং থাইল্যান্ডের সঙ্গে ২০১৫ সালে ভারতের সেপা চুক্তি হয়। অতএব, এই ব্যাপারে দ্রুত ও যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে আমরা আশা করি।