ব্রাক্ষণবাড়িয়ার আদালতে বিচারকের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে এ ধরনের ঘটনায় যাতে কেউ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে সেদিকেও নজর রাখতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি ওই আদালতের বিচার কাজের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে আইনজীবী নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন হাইকোর্ট।
তলব আদেশে ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতিসহ তিন আইনজীবীর হাজিরার পর মঙ্গলবার বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও কার্যকরী কমিটির নেতৃবৃন্দ, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সম্পাদকের প্রতি এই আহ্বান জানান বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ।
আইনজীবীদের উদ্দেশে আদালত বলেছেন, যখন একটি ঘটনা ঘটে তখন প্রতিক্রিয়াশীল অনেক গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে পড়ে। তাদের উদ্দেশ্য থাকে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা। লক্ষ্য রাখতে হবে এ ধরনের কোন গোষ্ঠী যেন রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা না করতে পারে। যে ঘটনা ঘটেছে যেন রাষ্ট্রকে অকার্যকর করার মত অবস্থা। আপনারা যেন আগুন নিয়ে খেলছেন। এই আগুন থামান, পরিস্থিতি শান্ত করুন। নইলে সবাইকে জ্বলতে হবে। হাইকোর্ট বলেন, বিচারক ও আইনজীবী নিয়েই আদালত। এটাকে ভিন্নভাবে দেখার সুযোগ নাই। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে আদালত পেশী শক্তি প্রদর্শনের জায়গা নয়।
আইনজীবী নেতারা বলেন, আমরা বসে নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার সকল প্রচেষ্টা চলছে। ওই জেলার আইনজীবী সমিতির নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর সেখানকার আদালতে দু’দিন ধরে বিচার কাজ চলছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের ঘটনায় জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতিসহ তিন আইনজীবীকে ৫ জানুয়ারি তলব করে হাইকোর্ট। ওই তলব আদেশে গতকাল হাইকোর্টে হাজিরা দেন সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট তানভীর আহমেদ ভূঞা, সম্পাদক (প্রশাসন) অ্যাডভোকেট মো. আক্কাস আলী ও অ্যাডভোকেট জুবায়ের ইসলাম। তাদের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. মোমতাজউদ্দিন ফকির ও সম্পাদক আবদুন নূর দুলাল, বার কাউন্সিলের কার্যকরী কমিটির নেতা অ্যাডভোকেট সাঈদ আহমেদ রাজা, অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক প্রমুখ।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এএম আমিন উদ্দিন। শুনানির শুরুতেই সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি বলেন, হাইকোর্ট রুল জারি করেছে। এজন্য দুই মাস সময় চাই। আদালত বলেন, ব্যাখ্যা দিতে দুই মাস সময় কেন? ব্যাখ্যা দেওয়া মানে আপনি রুলের কনটেস্ট করবেন? বার সভাপতি বলেন, আমরা কনটেস্ট করব না।
আদালত বলেন, ব্রাক্ষণবাড়িয়া আদালতের ঘটনা শুধু দেশেই নয়, সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। আদালত কক্ষে এ ধরনের ঘটনা আগে ঘটেনি। সভ্যতা বিবর্জিত ঘটনা এটি। আমরা কোন দিকে যাচ্ছি সেটা আমাদের সবার ভাবার বিষয়।
সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া বার সভাপতি সাধারণ আইনজীবীদের স্বার্থে কথা বলেছেন। উনি ব্যক্তিগত স্বার্থে এটা করেননি। হাইকোর্ট বলেন, শুধু ভোটের চিন্তা করবেন না। আদালতকে অসম্মান করলে তা কারো জন্য শুভ হবে না। আদালতকে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে, তাহলে আপনারা সম্মান পাবেন। আদালত না থাকলে আপনারাও থাকবেন না।
সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনায় শুধু আইনজীবীদের তলব করা হয়েছে। কিন্তু বিচারক যে ঘটনা ঘটিয়েছেন সেজন্য উনার প্রতি আদালত অবমাননার রুল জারি করা উচিত ছিল। আইনজীবীদের সঙ্গে বিচারক খারাপ আচরণ করেছেন। আইনজীবীরা কতদিন এ আচরণ সহ্য করবে। এ পর্যায়ে আদালত কক্ষে উপস্থিত আইনজীবীরা বার সভাপতির বক্তব্যকে সমর্থন করে ‘ইয়েস’ ‘ইয়েস’ ধ্বনি তোলেন।
তখন হাইকোর্ট বলেন, এখানে কি বার ও বেঞ্চের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে? এটা সত্যিই অপ্রত্যাশিত। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা তো এ রকম করতে পারে না। আদালত কক্ষে কি বাইরে থেকে লোক ঢুকেছে। এ সময় ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, যারা এই আদালত কক্ষের পরিবেশকে বিনষ্ট করছেন তারা বেরিয়ে যান।
সুপ্রিম কোর্ট বার সম্পাদক বলেন, ওই ঘটনায় জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন বিবৃতি দিয়েছে। বিচার বিভাগের মর্যাদার কথা বিবেচনা করে আমরা কোন বিবৃতি দেয়নি। বিবৃতি দিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতো। জেলা আদালতের নাজিরের জাল কোর্ট ফি বিক্রয়ের প্রতিবাদ করার প্রেক্ষিতে ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় এ ঘটনার সৃষ্টি। একজন বিচারক কেন নাজিরের পক্ষ নেবেন, দুঃখজনক।
অ্যাডভোকেট শাহ মঞ্জুরুল হক বলেন, বিচারকের দিক থেকে ওই ঘটনার ভিডিও করে সামাজিক মাধ্যমে ছাড়া হয়েছে। যদিও আদালত কক্ষের কোন ঘটনার ছবি বা ভিডিও ধারণ করার সুযোগ নাই। আদালত বলেন, বিচারক ভুল করতে পারেন। এজন্য প্রধান বিচারপতি, আইনমন্ত্রী আছেন। তাদের কাছে বিচার চাইতে পারতেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, যে ঘটনা ঘটেছে তা দুর্ভাগ্যজনক। সবার সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতিকে শান্ত করার চেষ্টা চলছে। যে ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাড়া হয়েছে তা অপসারণের জন্য বিটিআরসিকে নির্দেশনা দিন।
হাইকোর্ট বলেন, আমরা ব্রাক্ষণবাড়িয়া আদালতের প্রতিটি ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছি। এখানে বিচার বিভাগের অস্তিত্বের প্রশ্ন রয়েছে। শুধু বিচার বিভাগ নয়, বারেরও অস্তিত্বের প্রশ্ন। সেখানকার আইনজীবীদের বোঝান। হাইকোর্ট বলেন, রাষ্ট্রপতি ছাড়া কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আমাদের কঠোর আদেশ দিতে বাধ্য করবেন না। এই ঘটনার সর্বশেষ দেখব। কোন ছাড় দেয়া হবে না। সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি বলেন, সময় দিন, রাষ্ট্রকে কারা অকার্যকর করেছে সেটাও বলব।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সময় চেয়েছে তাদের সময় দিন। যাতে উদ্ভূত পরিস্থিতি শান্ত হয়ে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করে। আদালত বলেন, আমরা পিরোজপুর ও খুলনার ঘটনায় নমনীয় মনোভাব দেখিয়েছি। বদ্ধ দরজার মধ্যে অনেক কিছুই করা যায়। দরজা খুলে দিলে সংযত থাকতে হয়। শুনানি শেষে হাইকোর্ট ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়ে ভিডিও অপসারণ করতে বিটিআরসিকে নির্দেশ দেন।