অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ সালের বাজেট পেশ করেছেন। দুর্দান্ত বাজেট, এই বাজেট পেশ করার পর সারা বাংলাদেশে আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে। চার দিকে শুধু টাকা আর টাকা। মন্ত্রীরা অনর্গল সত্য কথা বলছেন। কেউ কেউ বলছেন, ‘আগে আমরা সারা দিনে-এক বেলা খেতাম, এখন তিন বেলা খাই।’ আরেক মন্ত্রী আরেকটু সামনে এগিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের পাঁচ কোটি লোক ইউরোপিয়ানদের মতো জীবনযাপন করে।’ কেউ বলেছেন, ‘মানুষের আয় বেড়েছে, জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, ফলে দ্রব্যমূল্য তো কিছুটা বাড়বেই।’ খুবই হক কথা। তার ভাষ্যমতে, ইউরোপ-আমেরিকায়ও অনেক লোক দরিদ্র, তিন বেলা খেতে পায় না, অনেক লোক সেখানে রাস্তায় ঘুমায়। এটা কিন্তু পুরোপুরি সত্য। সাধারণত, ওই সব দেশে ড্রাগ অ্যাডিক্টরা রাস্তায় ঘুমায়। তবে, তারা কেউ না খেয়ে থাকে না, সরকারের তরফ থেকে তাদের খাদ্য দেয়া হয়। এমনকি বিনামূল্যে ড্রাগও দেয়া হয়, যাতে তারা চুরি-ডাকাতি ছিনতাই না করে। এদেরই বেশির ভাগ রাস্তায় ঘুমায়। পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে ভরে না। তাদের ধরে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কাউন্সেলিং করে। এর ফলে এদের অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।
মন্ত্রীরা অবিরাম বাংলাদেশের সাফল্যগীত গাইছেন। বলছেন, এ দেশে কেউ না খেয়ে নেই। তা ছাড়া শেখ হাসিনা সরকার গৃহহীনদের জন্য ঘর বানিয়ে দিয়েছে। এসব ঘরের বেশির ভাগই ভেঙে পড়েছে, তাতে কী? ঘর তো দিয়েছে, আর দ্রব্যমূল্য বাড়বে না-বা কেন? সারা পৃথিবীতে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। গৎবাঁধা বক্তব্য। কেউ আমাদের বলে না যে, পৃথিবীর কোন কোন দেশে চালের মূল্য প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। চিনি, চাল, ডাল, পেঁয়াজের দাম কত টাকা থেকে কত টাকা হয়েছে, যদি সে রকম একটা পরিসংখ্যান দেয়া হতো যে, নিউ ইয়র্কে চালের দাম ৮০ টাকা থেকে বেড়ে ২০০ টাকা হয়েছে, তাহলে বুঝতে পারতাম, সারা পৃথিবীতে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধির জন্য বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের যুক্তি দেখানো হয়। এটা যুক্তি বটে, তবে কোনো জিনিসের দাম যদি ১০০ টাকা বেড়ে থাকে তাহলে, বাংলাদেশে এর প্রভাবে চালের দাম ১০-২০ পয়সা বাড়তে পারে, ১০-২০ টাকা নয়।
এ বাজেটে পাচার করা টাকা নিয়ে আজব কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, পাচার করা টাকা যদি কেউ ফেরত নিয়ে আসে, তবে তাকে রেমিট্যান্সের সুবিধা দেয়া হবে। অর্থাৎ, এই টাকাচোরদের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী হিসেবে গণ্য করা হবে এবং ওই টাকার ওপর তাদের প্রণোদনাও দেয়া হবে। চোর-বাটপাড়, প্রতারক-ঘুষখোর ও লুটেরাদের প্রতি সরকার কী আশ্চর্য সহানুভ‚তিশীল। এই যেমন ধরা যাক, পি কে হালদার ১০ হাজার কোটি টাকা চুরি করেছেন। কানাডা, ভারত, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশে সেসব টাকা পাচার করেছেন। ঘরবাড়ি কিনেছেন, বানিয়েছেন, নতুন নতুন ব্যবসায় খুলে বসেছেন। এসব টাকা পাচারে বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা তাকে সহযোগিতা করেছেন। সহযোগিতাকারীদের মধ্যে রয়েছেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এইচ কে সুরসহ আরো অনেক কর্মকর্তা।
এই টাকা পাচারে যারা সহায়তা করেছেন তাদের কেউই বিনা স্বার্থে করেননি। নিশ্চয় তারা এর ভাগ পেয়েছেন। তাহলে কী দাঁড়াল? যারা চুরি, ডাকাতি, বাটপাড়ি, জালিয়াতি, চালিয়াতি করল, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করল, সেখানে স্ত্রী-সন্তান পাঠিয়ে দিয়ে বেগমপাড়ার জন্ম দিলো, তারাই হয়ে গেল সমাজের এলিট শ্রেণী। আর যারা দিনে ষোলো ঘণ্টা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে এই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে তারা দেশের এবং বিদেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে লাথি খেতে থাকল এবং কর্মক্ষেত্রে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হলো। তারা থাকল অপাঙ্ক্তেয় হয়ে। টাকা কিন্তু এরাই উপার্জন করে। পাচার করে এলিটরা। টাকা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা এলিটদের জন্যই। এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেটে কর দিয়ে পাচার হওয়া অর্থ দেশের মূলধারার অর্থনীতিতে যুক্ত করতে সফল হবেন বলেও তিনি মনে করেন। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও তা আমলে নিচ্ছেন না অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, যারা টাকা নিয়ে গেছেন তারা বুঝতেই পারেননি, না বুঝেই নিয়ে গেছেন। সে জন্যই তো সে কালো টাকা হোয়াইট করতে সেগুলোকে আমাদের অর্থনীতির মূল ধারায় আনতে এ কাজটি করা হয়। তার মতে, বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দেশের মানুষের হক। আর এই হক তিনি ফিরিয়ে আনতে চান। যারা দেশ থেকে টাকা নিয়ে বিদেশে সম্পদ গড়েছেন তারা বাজেটে প্রস্তাবিত সুযোগ নিয়ে সেই টাকা ফিরিয়ে আনবেন বলে তার বিশ্বাস।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। প্রতি বছরই এই সরকার দলীয় লুটেরাদের জন্য কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু বছর শেষে দেখা গেছে, ২০-৫০ কোটি টাকা মাত্র সাদা করা হয়েছে। বাকি লুটের মাল লুটেরাদের হাতেই থেকে গেছে। টাকা ফিরিয়ে আনলে টাকা সাদা হবে, প্রণোদনা পাওয়া যাবে, এমন কথায় সৎ লোকেরা আকৃষ্ট হতে পারত, কিন্তু অসৎ লোকেরা তা কখনো হবে না। তাদের সংশয় থেকে যেত যে, যদি টাকার কথা প্রকাশ করি, তাহলে আম-ছালা দুই-ই নাকি যায়। তার চেয়ে কানাডা, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে ঘরবাড়ি, ব্যবসাবাণিজ্য কিনে, চাই কী আরেকটি বিয়ে করে সুখে শান্তিতে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবো।
এ প্রসঙ্গে, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, এমন একটি বাজেট দেয়া হলো যেখানে পাচারকারীদের টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ আছে, অথচ কর ফাঁকি রোধে কঠোর কোনো পদক্ষেপের কথা বলা হয়নি। বাজেটে বিত্তবানদের জন্য সুবিধাই দেয়া হয়েছে। বিদেশ থেকে অর্থ আনার বিষয়টি সম্পূর্ণ অনৈতিক। আরেকটি বিষয় হলো, এটি কখনো বাস্তবায়নযোগ্য নয়। তার চেয়ে বড় কথা হলো, এটা অনৈতিক। এক দিকে পাচারের সুযোগ দিয়ে, আবার অর্থ ফিরিয়ে আনার সুযোগ করে দেবো; অন্য দিকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য করে ছাড় থাকবে না, এটা সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। এই বাজেটে সুকৌশলে ধনীকে আরো ধনী, গরিবকে নিষ্পেষিত করার ব্যবস্থা রয়েছে। অনেকসময় সরকার এসব ক্ষেত্রে রাখঢাক করত, এবার (সৎ) সরকার রাখঢাকের ধার ধারেনি। টাকাওয়ালা, তুমি আরো টাকা বানাও, গরিব তুমি সরো, কচু খাও।