কিশোরকবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তারুণ্যের জয়গান গাহিয়া লিখিয়াছিলেন ‘এদেশের বুকে আঠার আসুক নেমে’। জীবনভর তারুণ্যের বন্দনাগীত গাহিয়া গিয়াছেন কবি নজরুল। তরুণ প্রজন্মকে লইয়া সকলের মতো আশাবাদী হইতে চাহি আমরাও। কিন্তু যেই তরুণ প্রজন্মকে আমরা দেখিতেছি, তাহাতে অনেক সময় আমাদের আশার গগনে কেবল কালো মেঘই জমিতেছে! প্রতিনিয়ত যেই সকল কিশোর-অপরাধের খবর শুনা যায়, তাহা সমাজ ও দেশের জন্য নিঃসন্দেহে চরম উৎকণ্ঠার। পরিবারকাঠামোর দ্রুত পরিবর্তন, শহর ও বস্তির ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ কিংবা সমাজজীবনে বিরাজমান নৈরাজ্য ও হতাশা থেকেই মূলত অন্ধকার জগতে পা বাড়াইতেছে আাামদের একশ্রেণির কিশোর। ইহার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে যুক্ত অপসংস্কৃতির বাঁধভাঙা জোয়ার।
অপরিণত বয়সে অপরিমিত অর্থপ্রাপ্তি, অপ্রাপ্তবয়স্কের হাতে প্রযুক্তি পণ্য, অসৎ সঙ্গ, অতিরিক্ত চাহিদা, উচ্চাশা, পারিবারিক হতাশা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় মাস্তান-সন্ত্রাসীর সঙ্গে সংস্পর্শ ও অপসংস্কৃতির ছোঁয়া—মোটা দাগে এইগুলিই কিশোর সমাজকে অপরাধপ্রবণ করিয়া তুলিতেছে। কি শহর কি গ্রাম—সর্বত্রই বাড়িয়াছে কিশোর-অপরাধ। অপহরণ, হত্যা, চাঁদাবাজি হইতে শুরু করিয়া এমন কোনো অপরাধ নাই, যাহাতে কিশোর গ্যাংয়ের নাম যুক্ত হয় নাই। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের নগর-মহানগর এমনকি গ্রামগঞ্জ-পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত দাপাইয়া বেড়াইতেছে বখাটে কিশোররা। তাহাদের বেপরোয়া চলাফেরা, উদ্ভট আচরণ ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের লাগাম টানিতে হিমশিম খাইতেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। সম্প্রতি পাবনার বেড়া উপজেলায় একজন বখাটে কলেজছাত্রীকে মারধর করিয়া রক্তাক্ত করিলে সেই মেয়েটি বাড়ি গিয়া আত্মহত্যা করেন। বখাটেদের দৌরাত্ম্যের কারণে আজ নারীর নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়িয়াছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলিতেছেন, আইনের ফাঁকফোকরে কিশোররা ‘শিশু’তে সংজ্ঞায়িত হওয়ার কারণে কিশোর গ্যাং দমনে বড় প্রতিবন্ধক হইয়া উঠিয়াছে। ইহার ফলে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা বড় ধরনের অপরাধ করিয়াও পড়িতেছে লঘু শাস্তির আওতায়। এই অবস্থায় শিশুর বয়সসীমা পুনর্নির্ধারণ করিবার কথা বলিতেছেন অনেকে। আমাদের বক্তব্য হইল, যে কোনো মূল্যে কিশোর গ্যাং কালচারকে থামাইতে হইবে। দেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের ‘মহা সময়’ অতিক্রম করিতেছে। এমন একটি মুহূর্তে তরুণ প্রজন্মকে মাঠের বাহিরে রাখিয়া যে কোনো টেকসই উন্নয়নের কথা চিন্তা করাটা অবান্তর। অর্থাৎ বিপথে যাওয়া তরুণ সমাজকে কী করে সমাজের মূলধারায় যুক্ত করা যায়, তাহা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার। উদ্বেগজনক খবর হইল, ছিন্নমূল শিশু-কিশোরদের দারিদ্র্যের সুযোগ লইয়া তাহাদের দিয়া বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটাইবার অভিযোগ আছে সন্ত্রাসী চক্রের বিরুদ্ধে। এমনকি চুরি, ছিনতাইয়ের মতো ছোটখাটো অপরাধের বাহিরে মাদক বিক্রি, অস্ত্র ও বোমা বহনের মতো মারাত্মক কাজকর্মে ছিন্নমূল কিশোরদের ব্যবহার করিবারের অভিযোগ রহিয়াছে। এইভাবে অর্থের প্রলোভনে পড়িয়া কিশোররা একসময় অপরাধজগতের স্থায়ী সদস্যে পরিণত হয়। এই প্রবণতা স্বত্বর বন্ধ করিতে না পারিলে আগামী দিনে কঠিন বিপদের সম্মুখীন হইতে হইবে আমাদের। সুতরাং, সময় থাকিতেই ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যাবশ্যক। আমাদের জানামতে কিশোর গ্যাং সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ডাটা বেইজ তৈরি ও বিস্তর গবেষণা করিবার কথা—এই সব লইয়া সংশ্লিষ্ট মহল কাজ করিতেছেন বলিয়া আমাদের বিশ্বাস।
মূলত ১৯৭০ সালের পর হইতে বিশ্বব্যাপী কিশোর গ্যাং কালচার ব্যাপক সহিংসতার যুগে প্রবেশ করে। আর বাংলাদেশে কিশোর গ্যাং শিকড় গাড়িয়া বসে, বিশেষ করিয়া এক যুগকাল পূর্ব হইতে। বিগত কয়েক বৎসর সন্ত্রাসী সংস্কৃতির অস্তিত্ব জানান দিয়া ইহাদের কর্মকাণ্ড উঠে আসে আলোচনার শীর্ষে। এইখানে দুঃখজনক বিষয় হইল, অন্যান্য দেশ কিশোর গ্যাংয়ের মূলোৎপাটনে সফল হইলেও আমাদের অবস্থান বরাবরই ব্যর্থতার তালিকায়। শিশু-কিশোরদের সৃজনশীল কাজের পরিবেশ তৈরিসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণে আমরা কতটা আন্তরিক তাহাই ভাবিবার বিষয়।