কিছুদিন আগে মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বিশ্বের তরুণদের জন্য দারুণ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। টুইটে তিনি বলেছেন, ‘পুনরায় যদি আমি কলেজ জীবনে ফিরে যেতাম, তাহলে আমার পড়ালেখার বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিতাম আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, এনার্জি বা বিদ্যুৎ ও বায়োসায়েন্স।’ অর্থাৎ বিল গেটস মনে করেন, আগামী বিশ্বে ছড়ি ঘোরাবে এই তিন বিষয়। বিদ্যুৎ ও বায়োসায়েন্স আমরা আগে থেকেই জানি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও (এআই) আমরা এখন অল্প অল্প জানি বটে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, এনার্জি বা বিদ্যুৎ ও বায়োসায়েন্স— এই তিন বিষয় এখন এই বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল ক্ষেত্র। প্রযুক্তি ও অর্থনীতি খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আসছে দুই দশকের মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এতটাই পরিবর্তন আসবে যে, প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার দিনদিন বৃদ্ধি পাবে। কারখানা, নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, এমনকি খুচরা বিক্রির দোকানগুলোতেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহৃত হবে। এছাড়া শক্তির উৎস হিসেবে নবায়নযোগ্য শক্তি, যেমন :সৌর ও বায়ুশক্তির ব্যবহার বাড়বে। আসছে ১৫ বছরের মধ্যেই বৈদ্যুতিক খাতে অবিশ্বাস্য পরিবর্তন ঘটবে। বিশ্বে জীবপ্রযুক্তির দ্রুত প্রবৃদ্ধি ঘটছে। তাই এই তিন ক্ষেত্রই হবে আগামী বিশ্বের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পড়ালেখার জন্যও এখন থেকে এই তিন বিষয়কে আমাদের দেশেও গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কারণ বদলে যাওয়া কাজের ভুবনের সঙ্গে আমাদেরও তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, গত তিন দশক ধরে উন্নত দেশে উৎপাদন শিল্পে কর্মরত মানুষের সংখ্যা কমছে। যেমন :পর্তুগাল, স্পেন ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশে ১৯৯১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এই ক্ষেত্রে প্রায় ১০ শতাংশ কর্মসংকাচন হয়েছে। এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই)।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আসলে কী? ১৯৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সুইডেনের প্রসিদ্ধ গৃহস্থালি বস্তুসম্ভার নির্মাণ সংস্থা আইকিয়া-র ইউরোপে প্রসার পেতে ৩০ বছর সময় লেগেছিল, সাত দশক পর আজ তার বার্ষিক বিক্রি ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; অথচ চীনা ই-বাণিজ্য সংস্থা আলিবাবা-র ব্যবহারকারীর সংখ্যা মাত্র দুই বছরেই ১০ লাখে পৌঁছেছে, ১৫ বছরে তাদের বিক্রয়লব্ধ অর্থ ৭০০ বিলিয়ন ডলার। বলা যায়, এক সুসংবদ্ধ ইন্টারনেট-ভিত্তিক ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণেই এই অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি। সেই কাজটি করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ইতিপূর্বে বিশ্বব্যাংকের একটি ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টে বলা হচ্ছে, বিশ্বে কাজের ভরকেন্দ্র সরে গিয়েছে পরিষেবা ক্ষেত্রের দিকে। নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে শ্রম-ঘনিষ্ঠ শিল্প বেশি, সেখানে শ্রমের বাজারের ভূমিকা উৎপাদন শিল্পে এখনো টিকে আছে; কিন্তু সেখানেও বৃদ্ধিটা হচ্ছে প্রধানত সেই পরিষেবা খাতেই। অন্যদিকে ম্যানুফ্যাকচারিং বা উত্পাদনশিল্পে দ্রুত কাজ হারাচ্ছেন শ্রমিকেরা। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অভিঘাতে সংগঠিত কাজের জায়গাগুলো দখল করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ইন্টারনেট অব থিংস, যন্ত্র মনুষ্য-শ্রমকে প্রতিস্থাপন করছে। মজুরির খরচ প্রায় শূন্যে নেমে আসছে, মুনাফার হার পাচ্ছে অতি-ঊর্ধ্বগতি। এর ফলে, ভবিষ্যতে এক দিকে তৈরি হতে চলেছে অতি উচ্চ ধনীদের একশ্রেণি, অন্য দিকে তাদের কর্মক্ষেত্রে উৎপাদনের জন্য দিনরাত ২৪ ঘণ্টা সপ্তাহে সাত দিন কর্মরত মজুরি বিহীন যন্ত্রদল, যার চালিকাশক্তি মূলত বিদ্যুৎ।
কাজের দুনিয়ার কাঠামো বদলের একটা বড় দিক হলো ‘গিগ ইকনমি’র বিস্তার। গিগ ইকনমি হলো চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী কাজের দুনিয়া, যেমন বিভিন্ন অ্যাপের সাহায্যে কেনা খাবার কিংবা যে কোনো সামগ্রী বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কাজ। এই গিগ অর্থনীতির বিকাশে বিশ্ব জুড়ে দ্রুত ‘স্বাধীন’ কর্মী-বাহিনীর বিস্তার ঘটছে। বাংলাদেশেও এর হাওয়া লেগেছে। পাশাপাশি, প্রায় সব দেশেই প্রসারিত হচ্ছে ‘প্ল্যাটফরম ফার্ম’—যাকে বলা যায় অ্যাপ-ভিত্তিক ব্যবসাবাণিজ্যের সংস্থা। যেমন : একটি চীনা অনলাইন প্ল্যাটফরম সংস্থা সে দেশের ৫ লাখ ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে আমেরিকার ৬০ হাজার শিক্ষকের অনলাইন যোগাযোগের মাধ্যমে ইংরেজি শেখার আয়োজন করেছে। এটা একটা উদাহরণ মাত্র। আগামীর দিনে শিক্ষার জগতেও এই পরিবর্তনের বড় প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, ২০১৮ সালে যে শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি হয়েছে, তারা বড় হয়ে এমন পেশা ও কাজে প্রবেশ করবে যেগুলোর এখন কোনো অস্তিত্বই নেই। ফলে, কলেজে ভর্তি হয়ে প্রযুক্তির পাঠ নিয়ে চার-পাঁচ বছর পর একজন ছাত্র যখন পাশ করে বেরুবে তখন তারা দেখবে যে, তাদের শেখা প্রযুক্তির আমূল বদল ঘটে গেছে। তাই বিশেষজ্ঞরা জোর দিচ্ছেন মানবপুঁজি গঠনের ওপর। কিন্তু সেখানে এখনো ধোঁয়াশা আছে। তবে এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বলা হচ্ছে, প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দিকটা। প্রযুক্তির বিস্ময়কর পরিবর্তনের অভিঘাতে মানবপুঁজির প্রয়োজন কীভাবে বদলাবে, সেটা এখনো অজানা, অর্থাৎ পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। কিন্তু এটুকু স্পষ্ট যে, বিপুল ও বিস্ময়কর প্রাযুক্তিক পরিবর্তন অতি দ্রুতই ঘটে চলেছে। আমাদের পঠনপাঠনকেও এর সমান্তরালে আপডেটেড করতে হবে। মানবসম্পদের বিকল্প ব্যবহার ও কর্মসংস্থান নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে এখন থেকেই।