মাসুম হোসেন বেসরকারি কোম্পানির কর্মকর্তা। স্ত্রী-সন্তানসহ তিনজনের ই-পাসপোর্ট প্রয়োজন। পাঁচ বছর মেয়াদি ৪৮ পৃষ্ঠার বইয়ের জন্য অনলাইনে করেছিলেন আবেদন। এ সপ্তাহেই তিনজনের আঙুল ও চোখের মণির ছাপ এবং ছবি তোলার দিনক্ষণ। গত রোববার ব্যাংকে টাকা জমা দিতে গিয়েই মাসুমের আক্কেল গুড়ূম। জানতে পারেন, ৪৮ পৃষ্ঠার পাসপোর্ট বইয়ের টাকা জমা নেওয়া বন্ধ, শুধু ৬৪ পৃষ্ঠার আবেদনের বিপরীতে জমা দেওয়া যাবে টাকা।
মাসুম হোসেন জানান, তাঁর আবেদনের বিপরীতে প্রতি পাসপোর্টের জন্য চার হাজার ২৫ টাকা করে ফি জমা নেওয়ার কথা। ব্যাংক কর্মকর্তা ৬৪ পৃষ্ঠার পাসপোর্টের জন্য আরও ২ হাজার ৩০০ টাকা করে অতিরিক্ত ফি জমা দিতে বলেন। এতে তাঁর তিনটি আবেদনে অতিরিক্ত ৬ হাজার ৯০০ টাকা লাগবে। সেই টাকা সঙ্গে না থাকায় তিনি ব্যাংক থেকে ফিরে যান।
তাঁর প্রশ্ন, জীবনে প্রথম পাসপোর্ট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। ৪৮ পৃষ্ঠাই তো পাঁচ বছরে শেষ করতে পারব না, এত টাকা দিয়ে ৬৪ পৃষ্ঠার বই নিয়ে কী করব?চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়া প্রয়োজন হাবিবুর রহমানের। করেছেন পাসপোর্টের আবেদনও। গতকাল পুরান ঢাকার বংশালে এক ব্যাংকে টাকা জমা দিতে এসে জানতে পারেন, ৬৪ পৃষ্ঠা ছাড়া আবেদনের ফি জমা নেওয়া হচ্ছে না। পেশায় দোকান কর্মচারী হাবিবুর বলেন, ‘৬০ বছর বয়স আমার। চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে পাসপোর্ট করার উদ্যোগ নিয়েছি। হয়তো জীবনে একবারই পাসপোর্ট লাগবে। তাহলে এত ভারী পাসপোর্ট তো আমার দরকার নেই।’
তিনি বলেন, ‘এমনিতেই চিকিৎসা খরচ, সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। তার ওপর পাসপোর্টে খরচও বেহুদা বেড়ে গেল।শুধু মাসুম কিংবা হাবিবুরই নন, ৪৮ পৃষ্ঠা পাসপোর্ট বন্ধ থাকায় হাজার হাজার গ্রাহক অতিরিক্ত টাকা খরচা করে ৬৪ পৃষ্ঠার বইয়ের আবেদন করতে বাধ্য হচ্ছেন। হঠাৎ করে এই অতিরিক্ত টাকা খরচের প্রভাব পড়ছে তাঁদের জীবনযাত্রার মাসিক খরচেও।
এমনিতেই ভোজ্যতেল থেকে গ্যাস; বাজারের সব নিত্যপণ্যের আগুনদাম। এবার পাসপোর্ট তৈরির খরচও গ্রাহকের শরীরে জ্বালা ধরাচ্ছে! যে ৪৮ পৃষ্ঠার ই-পাসপোর্ট একজন গ্রাহক ৪ হাজার ২৫ টাকায় পেতে পারতেন, অহেতুক ৬৪ পৃষ্ঠার পাসপোর্ট গছিয়ে দিয়ে আরও দুই হাজার ৩০০ টাকা বেশি খরচ করানো হচ্ছে। তবে কেন হঠাৎ ৪৮ পৃষ্ঠার পাসপোর্টের আবেদন জমা নেওয়া বন্ধ, সে তথ্য জানেন দেশের বিভিন্ন পাসপোর্ট অফিসে যোগাযোগ করে জানা যায়, গত ২৯ মে থেকে ৪৮ পৃষ্ঠার পাসপোর্টের আবেদন জমা নেওয়া বন্ধ। অফিসগুলোতে এ সংক্রান্ত নোটিশও টানানো রয়েছে। তথ্যটি আছে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটেও।
রাজধানীর কাছাকাছি এক জেলার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অধিদপ্তর থেকে ৪৮ পৃষ্ঠার আবেদন জমা নেওয়া বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছি। কী কারণে তা বন্ধ রয়েছে এবং কবে চালু হবে, তা জানি না।
অবশ্য ইমিগ্রেশন অ্যান্ড পাসপোর্ট অধিদপ্তরে মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ূব চৌধূরী বলেন, ৪৮ পৃষ্ঠার পাসপোর্টের আবেদন নেওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়নি, দেশে সাময়িকভাবে তা বন্ধ রয়েছে। তবে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনগুলোতে ৪৮ পৃষ্ঠার আবেদন জমা নেওয়া হচ্ছে।না বা জানাতে চান না সংশ্নিষ্ট অফিসগুলোর কেউই।মহাপরিচালক বলেন, ৪৮ পৃষ্ঠার পাশাপাশি ৬৪ পৃষ্ঠার পাসপোর্টও বিতরণ করা হয়। তবে আমরা যে পরিকল্পনা করেছিলাম বা বিতরণের টার্গেট নিয়েছিলাম, সে অনুযায়ী ৬৪ পৃষ্ঠার আবেদন জমা পড়ছে না। ৬৪ পৃষ্ঠার বইগুলো দীর্ঘদিন রেখে দেওয়ায় নষ্ট হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় টাকার অপচয় রোধে বিশেষ ব্যবস্থায় শুধু ৬৪ পৃষ্ঠার আবেদন জমা ও বিতরণ করা হচ্ছে। এটি খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাঁচ বছর মেয়াদে ৪৮ পৃষ্ঠা পাসপোর্টের নিয়মিত আবেদনের ক্ষেত্রে বায়োমেট্রিক এনরোলমেন্ট শেষ করার পর ১৫ থেকে ২১ কার্যদিবসের মধ্যে পাসপোর্ট বিতরণ করা হয়। এক্ষেত্রে ফি ৪ হাজার ২৫ টাকা। জরুরি আবেদনে সাত থেকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে পাসপোর্ট পেতে ৬ হাজার ৩২৫ টাকা এবং অতি জরুরি অর্থাৎ দু’দিনের মধ্যে পাসপোর্ট পেতে (শুধু রি-ইস্যু) ৮ হাজার ৬২৫ টাকা ফি লাগে। ১০ বছরের জন্য একই পৃষ্ঠার পাসপোর্ট পেতে নিয়মিত বিতরণের ফি ৫ হাজার ৭৫০ টাকা, জরুরি বিতরণে ৮ হাজার ৫০ টাকা এবং অতি জরু৪৮ পৃষ্ঠার পাসপোর্টের আবেদন জমা নেওয়া বন্ধ থাকায় এখন গ্রাহককে ১৫ থেকে ২১ কার্যদিবসের মধ্যে ৬৪ পৃষ্ঠার পাঁচ বছর মেয়াদের পাসপোর্ট পেতে ৬ হাজার ৩২৫ টাকা, জরুরি আবেদনে ৮ হাজার ৬২৫ টাকা এবং অতি জরুরি আবেদনে ১২ হাজার ৭৫ টাকা করে লাগছে। ১০ বছর মেয়াদি আবেদনের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের যথাক্রমে ৮ হাজার ৫০ টাকা, ১০ হাজার ৩৫০ টাকা এবং ১৩ হাজার ৮০০ টাকা ফি জমা দিতে হচ্ছে।
কবে নাগাদ ৪৮ পৃষ্ঠার পাসপোর্টের আবেদন জমা নেওয়া শুরু হবে জানতে চাইলে ই-পাসপোর্ট প্রকল্পের পরিচালক মো. সাইদুর রহমান বলেন, হয়তো আগস্টের দিকে ফের ৪৮ পৃষ্ঠা পাসপোর্টের আবেদন জমা নেওয়া হতে পারে। তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে এরই মধ্যে যাঁরা ৪৮ পৃষ্ঠার জন্য আঙুলের ছাপ, চোখের মণি ও ছবি তুলেছেন, তাঁরা নির্ধারিত সময়েই পাসপোর্ট পাবেন। বিতরণেযাঁরা আগে ৪৮ পৃষ্ঠার আবেদন করে এখন ফি জমা দিতে চাচ্ছেন, তাঁদের বিষয়ে জানতে চাইলে ই-পাসপোর্টের এই কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের আবেদনকারীকে ব্যাংকে ৬৪ পৃষ্ঠার ফি জমা দিতে হবে। নির্ধারিত তারিখে ছবি তোলার সময় সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানালে আবেদনপত্রে সংশোধন করে ৪৮ পৃষ্ঠার স্থলে ৬৪ পৃষ্ঠা করে দেবেন।
১০ হাজার ৩৫০ টাকা ফি লাগে।