একটি দেশের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে শিক্ষা। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত। আমাদের দেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করার পর উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করে। উচ্চশিক্ষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাথমিক লক্ষ্যই হলো ‘গবেষণা’। গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি, উদ্ভাবন এবং তা বিতরণ করা। উচ্চশিক্ষার সঙ্গে তাই গবেষণা শব্দটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ কারণে গবেষণা ছাড়া উচ্চশিক্ষাকে একপ্রকার অর্থহীনই বলা যায়। অর্থাৎ, উচ্চশিক্ষাকে অর্থবহ করে তুলতে গবেষণার বিকল্প নেই। একটি দেশ গবেষণার মাধ্যমে চিন্তা ও মননশীলতার আধুনিক পথ খুঁজে পেতে পারে, যা সেই জাতিকে জ্ঞানবিজ্ঞানের উচ্চ শিখরে পৌঁছাতে এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করে।
উচ্চশিক্ষা অর্জনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা যদি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে লক্ষ করি, তাহলে হতাশাজনক চিত্রই দেখতে পাই। প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী বের হচ্ছে বটে। পর্যাপ্ত পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় গবেষণামুখী শিক্ষার অভাবে তারা বেকারই থেকে যাচ্ছে। আমাদের দেশে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে, যেখানে এখনো গবেষণামূলক কোনো বিভাগই প্রতিষ্ঠা করা যায়নি।
প্রকৃতপক্ষে গবেষণা করার জন্য যে সংস্কৃতি দরকার, বাংলাদেশে তা এখনো গড়ে ওঠেনি। গবেষণার মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে মেধাবী ছাত্রছাত্রী, সুযোগ্য গবেষক ও আর্থিক অবকাঠামো। এই তিনের সমন্বয়ে উচ্চমানের গবেষণা গড়ে ওঠে। এগুলো ছাড়া উন্নতমানের গবেষণা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। গবেষণা ফান্ড ও গবেষণা অবকাঠামোর অপ্রতুলতা পর্যাপ্ত গবেষণা না হওয়ার অন্যতম কারণ। ২০১৯ সালের সর্বশেষ ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ১২৫টি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সর্বমোট ১৫৩ কোটি টাকা গবেষণায় ব্যয় করেছে। অর্থাৎ, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গড় বার্ষিক খরচ ছিল ১ কোটি ২২ লাখ টাকা, যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মোট খরচের তুলনায় মাত্র ১ শতাংশ। ফলস্বরূপ, ২০২০ সালের গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান উল্লেখজনক ছিল না। গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে যেসব দেশে বার্ষিক ৫০ মিলিয়ন ডলারেরও অধিক অর্থ ব্যয় করে, সেরকম ৯০টি দেশের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের নাম থাকলেও বাংলাদেশের নামটি ছিল অনুপস্থিত।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও অনুদান না থাকার কারণে আমাদের দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা হতাশাজনকভাবে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। আমরা যদি উন্নত দেশগুলোর দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাই তারা গবেষণায় সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের তুলনায় তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশই শিক্ষা ও গবেষণায় যথেষ্ট এগিয়েছে। এর কারণ মূলত সেই সব দেশে শিক্ষা ও গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে। উন্নত দেশগুলোয় গবেষণা করার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকার কারণে গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও আবিষ্কার সম্ভব হচ্ছে, যা তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করে নেতৃস্থানীয় জায়গায় পৌঁছাতে সাহায্য করছে। এক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় এশিয়ার দেশগুলোতে উচ্চশিক্ষার পরিস্থিতি জাতীয়ভাবে অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। ২০০৩ সালে বসওয়ার্থ ও কলিনস একটি সমীক্ষায় বিশ্বের ৮৪টি দেশের শিক্ষার মান তদন্ত করে দেখিয়েছিলেন যে, ভারত ও শ্রীলঙ্কার কোয়ালিটি ইনডেক্স স্কোর ছিল ২০ দশমিক ৮, পাকিস্তানের ছিল ১১ দশমিক ৩ এবং যেখানে বাংলাদেশের স্কোর ছিল মাত্র ২ দশমিক ৮।
বর্তমান আধুনিক বিশ্বে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বের কোনো দেশ উন্নতমানের গবেষণার অবকাঠামো তৈরি না করে ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি। দক্ষ জনসম্পদ গড়ে তুলতে গবেষণামূলক শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আধুনিক শিক্ষায় পারদর্শী করে তোলে এবং তাদের সৃজনশীলতা বাড়াতে সহায়তা করে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারের উচিত দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ রিসার্চ সেন্টার চালু করা এবং শিক্ষা ও গবেষণা খাতে যথেষ্ট পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ দেওয়া। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করতে পর্যাপ্ত প্রণোদনা, ‘অ্যাওয়ার্ড ফর রিসার্চ’ প্রদান এবং গবেষণা সম্পর্কিত কনফারেন্সের আয়োজন করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব যে জার্নালগুলো আছে, যেখানে শিক্ষকেরা তাদের গবেষণার কাজগুলো প্রকাশ করেন, সেগুলোর মানোন্নয়নে প্রদক্ষেপ নিতে হবে। যেহেতু বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, সেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শুধু পাঠদানকেন্দ্রিক না করে গবেষণাকেন্দ্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিক্ষকগণ সময়ের ব্যবধানে পদন্নোতি পেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে চলে যান। যোগ্যতা যাচাই হয় না বিধায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণায়ও পিছিয়ে পড়ছে। তাই শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ করে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক নির্বাচনের সময় শুধু তাদেরই নিয়োগ দিতে হবে, যাদের কয়েক বছরের গবেষণার অভিজ্ঞতা রয়েছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তথা উপাচার্য মহোদয়কে মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণা সম্প্রসারণের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এজাতীয় বিষয় ভেবে দেখার সময় হয়েছে বৈকি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করবেন, জ্ঞানবিজ্ঞানের নিত্যনতুন দিক নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করবেন, সৃজিত জ্ঞান ও পরিবর্তিত ধারণা পরস্পরের মধ্যে বিতরণ করবেন—এ রকমটাই প্রত্যাশিত। পরীক্ষালব্ধ এই জ্ঞানকে সমাজের কল্যাণে কাজে লাগিয়ে দেশের অগ্রযাত্রা আরো গতিশীল হওয়ার মাধ্যমে দেশ হবে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশ শিক্ষা ও গবেষণায় সমৃদ্ধ হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতার থেকে দ্রুত উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে—এটাই সবার প্রত্যাশা।