সম্প্রতি পাকিস্তানে সৃষ্ট বন্যা বিশ্বব্যাপী বেশ হইচই ফেলে দেয়। মনুষ্যসৃষ্ট কারণেই মূলত পাকিস্তান এই বন্যার সম্মুখীন হয়েছে বলে মনে করছেন গবেষকরা। অর্থাৎ, পরিবেশের প্রতি মানুষের খামখেয়ালি কর্মকাণ্ডের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের হাত ধরে এহেন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
বন্যা হলো পানির ওভারফ্লো, যা শুকনো জমিকে ডুবিয়ে দেয়, চারপাশকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বন্যার কারণে প্রভূত ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হন ভুক্তভোগীরা। উদাহরণস্বরূপ—বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের প্রধান আর্থিক খাত হলো কৃষি। এখন যেসব অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি কৃষিকাজ হয়, সেসব অঞ্চল যদি বন্যায় প্লাবিত হয়, তাহলে কৃষিকাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে আর্থিক ব্যবস্থা। উপরন্তু মানুষ ও পশু-পাখির মৃত্যু তো বন্যার পরিচিত ঘটনা! এক সমীক্ষায় জানা গেছে, ২০১৫ থেকে ২০২০—এই ছয় বছরে বন্যার কারণে ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের। কী সাংঘাতিক! যেখানে তার আগের ছয় বছরে বন্যায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল মাত্র ৪ হাজার কোটি টাকার আশপাশে। ২০২২ সালের মে মাসে শুরু হওয়া বন্যায় সিলেট, সুনামগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হতে দেখেছি আমরা—যা ছিল স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। যার ক্ষতির পরিমাণ এখনো পূরণ করা সম্ভব হয়নি। এই বন্যার মূল কারণ ছিল মেঘালয়ের অতিবৃষ্টি। আমরা জানি, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে আবহাওয়া-জলবায়ু বা বৃষ্টির ধরন বদলে যায়। খুব বেশি পরিমাণ উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে অতিবৃষ্টি হয়। আর এই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হচ্ছে মানুষ।
আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে মানুষের অসাধ্য এখন কিছুই নেই। নগরায়ণ থেকে শুরু করে যত রকমের উন্নত যন্ত্রপাতি তৈরি ও ব্যবহার—সবই এখন নিত্যদিনের অনুষঙ্গ। নির্বিচারে গাছপালা কেটে বাসাবাড়ি বানানো হচ্ছে। অথচ আমরা যত বেশি বৃক্ষরোপণ করব সে জায়গার মাটি তত বেশি শক্ত ও মজবুত হবে এবং পানি ধারণক্ষমতা বেশি থাকবে। যার ফলে বন্যা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তাছাড়া অধিক বৃক্ষরোপণে পরিবেশও সুস্থ থাকবে। বৈশ্বিক উষ্ণতাও নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। এতে করে ঘনঘন অতিবৃষ্টি হবে না, হবে না বন্যাও। আবার বর্তমানে ফ্রিজ, রেফ্রিজারেটর, এসিসহ বিভিন্ন ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এসব যন্ত্রপাতি থেকে সিএফসি গ্যাস নির্গত হয়, যার ফলে পরিবেশে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ দিনদিন বেড়েই চলছে। এতে করে ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রকৃতি তার আপন গতি হারিয়ে ফেলছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে প্রাণিকুল এবং পুরো বিশ্ব।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ ব্যাপক ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই আমাদেরকে অবশ্যই প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীল হতে হবে। ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে যেন খুব বেশি কার্বন নির্গত না হয়। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর—এমন জিনিসপত্রের ব্যবহার ধীরে ধীরে বন্ধ করে দিতে হবে। নদীর নাব্য হ্রাস বন্যার আরেকটি অন্যতম কারণ। সুবিধার জন্য ব্যবহৃত ময়লা-আবর্জনা নদীর পানিতে না ফেলে নির্দিষ্ট জায়গায় পুঁতে বা পুড়িয়ে ফেললেই নদীর পানি দূষিত হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যাবে। এর ফলে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি পাবে ও নদীর পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। পাথর উত্তোলনের ক্ষেত্রেও সচেতনতা অতীব জরুরি। মোটকথা একমাত্র সচেতনতাই পারে প্রকৃতিকে বন্যার হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করতে। তা না হলে পাকিস্তানের মতো আমাদেরও ভয়ংকর পরিস্থিতির শিকারে পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। সুতরাং, জলবায়ু তথা প্রকৃতির প্রতি সবার দায়িত্বশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবাইকে একসঙ্গে পরিবেশ রক্ষায় কাজ করতে হবে। তবেই আমরা বন্যামুক্ত জীবনযাপন করতে পারব।