বৈদেশিক ঋণ বা সাহায্য ছাড়া আধুনিক বিশ্ব অনেকটাই চলে না। অর্থনৈতিকভাবে যত শক্তিশালী দেশই হোক না কেন, সেই দেশ বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করে যাকে। অবাক করা বিষয় হলো, বিশ্বের ২০৭টি দেশ এখন বৈদেশিক ঋণ নিচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর ঋণের পরিমাণও বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের মার্চ মাসে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল মাথাপিছু ২৬ হাজার ৫৫৩ ডলার, যা জিডিপির ৪২ শতাংশ; যুক্তরাজ্যের ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ লাখ ২৭ হাজার মার্কিন ডলার, যা জিডিপির ৩১৩ শতাংশ; জার্মানির ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত ৬৯ হাজার ডলার, যা জিডিপির ১৫৩ শতাংশ; জাপানের এই সময় পর্যন্ত ৩ হাজার ৮০০ ডলার, যা জিডিপির ৯৪ শতাংশ; ইতালির ২ হাজার ৯২১ সালে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪২ হাজার ৩০০ ডলার, যা জিডিপির ১২৪ শতাংশ; চীনের একই সময়ে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩২৬ ডলার, যা জিডিজির ১৫ শতাংশ। এমনিভাবে প্রতিটি দেশের রয়েছে বিশাল পরিমাণে বৈদেশিক ঋণ। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বিশ্বের ২০৭টি দেশ ঋণ গ্রহণ করছে বা করে থাকে। কা্জেই বিদেশি ঋণে কোনো খারাপ কিছু নয়। বাংলাদেশে বর্তমানে বৈদেশিক মাথাপিছু ঋণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এই ঋণের পরিমাণ অর্থনৈতিক তুলনায় খুব একটা বেশি বলা যাবে না।
একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া চালু রাখার জন্য বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থা থেকে যে ঋণ ও অনুদান পাওয়া যায়, তাকে বৈদেশিক সাহায্য বলা হয়। এই সাহায্য খাদ্য, ওষুধ, প্রকল্প, দান, অনুদান, ঋণ, আর্থিক ও কারিগরি যে কোনোভাবেই হতে পারে। তৃতীয় বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও সঞ্চয় বিনিয়োগ ও আমদানি-রপ্তানি অপরিহার্য হয়ে পড়ায় জাতীয় সঞ্চয় বৃদ্ধির প্রয়োজন দেখা দেয়। কিন্তু এ দেশের জাতীয় আয়ের উৎস থেকে অর্জিত অর্থ দ্বারা অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করা প্রায় অসম্ভব। তাই উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের প্রয়োজন দেখা দেয়। বিশেষ সুবিধা প্রদান সাপেক্ষে এক দেশ থেকে অপর দেশে সম্পদ হস্তান্তরকে বৈদেশিক সাহায্য বলে। ব্যাপক অর্থে বৈদেশিক সাহায্য বলতে সামরিক ও বেসামরিক পর্যায়ে সাময়িকভাবে অর্থ-সম্পদ ও কারিগরি সহায়তাকে বোঝায়। বৈদেশিক সাহায্য প্রদানের কারণ মূলত তিনটি। যথা—বাণিজ্যিক স্বার্থ, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ। অধিকাংশ বৈদেশিক সাহায্য যে মানবিক কারণে দেওয়া হয় না, তাতে কোনো সংশয় নেই। বৈদেশিক সাহায্য দেওয়ার সময় দাতা দেশ গ্রহীতা দেশের ওপর রাজনৈতিক শর্ত আরোপ করে কিংবা দেশের বৈদেশিক নীতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে। দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা উন্নয়নের জন্য একটি দেশে আধুনিক যন্ত্রপাতি ইত্যাদি আমদানির প্রয়োজন হয়। অধিকাংশ অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের রপ্তানি আয় কম অথচ চলতি আমদানি ব্যয় বেশি। অল্প পরিমাণ রপ্তানি আয় দিয়ে অধিক আধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানি করা সম্ভব হয় না। ফলে বাণিজ্য ব্যবধান সৃষ্টি হয়। এই ব্যবধান দূর করার জন্য অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ বাহ্যিক উৎস থেকে বিভিন্ন ধরনের মেয়াদি ঋণ বা সাহায্য গ্রহণ করে। অনেক সময় কোনো দেশ আকস্মিকভাবে বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়তে পারে। এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য আমদানির বাড়তি ব্যয় মেটানোর জন্য তারা বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ করতে পারে। অনেক দেশ আছে, যাদের নিয়মিতভাবে খাদ্যে ঘাটতি থাকে। খাদ্যের এই ঘাটতি পূরণের জন্য এসব দেশ বিদেশ থেকে খাদ্যসাহায্য গ্রহণ করে থাকে। অনুন্নত দেশে অভিজ্ঞ ও দক্ষ জনশক্তি তুলনামূলকভাবে কম। অথচ দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অভিজ্ঞ ও দক্ষ জনশক্তির বিকল্প নেই। তাছাড়া উন্নয়নশীল দেশের উৎপাদন কৌশলও আধুনিক ও যুগোপযোগী নয়। এজন্য এসব দেশ কারিগরি ব্যবধান দূর করতে বিদেশ থেকে কারিগরি সাহায্য নিতে পারে।
তবে একটি দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় অতিমাত্রায় বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়। বিদেশি দাতা সংস্থা বা দেশগুলো নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। বিভিন্ন দাতা বা সংস্থাসমূহ তাদের ঋণের বিপরীতে বিভিন্ন শর্ত আরোপ করে। অনেক ক্ষেত্রে এসব শর্ত সাহায্য গ্রহণকারী দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বৈদেশিক দাতা সংস্থা বা দেশসমূহ ঋণসহায়তা প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে অনেক সময় উচ্চহারে সুদ প্রদানের শর্ত জুড়ে দেয়। ফলে ঋণের বিপরীতে সুদের হারও ক্রমান্বয়ে বাড়ে। ফলে ঋণ গ্রহণকারী দেশের পক্ষে ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। ইতিপূর্বে বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋণের সুদ ছিল শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে উক্ত ঋণের সুদ হয়েছে ২ দশমিক শূন্য শতাংশ।
বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য অনেক সময় বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাছাড়া দেশের বাজেটের একটি বিরাট অংশ বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বৈদেশিক সাহায্য সময়মতো ও যে পরিমাণ প্রত্যাশা করা হয়, তা পাওয়া যায় না। ফলে বৈদেশিক সাহায্যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ করতে পারে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে সাহায্য নয়, বাণিজ্যই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। অর্থাৎ, বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো দরকার।