বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির মাসিক জরিপ অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর মাসে ৬৮ শতাংশ মানুষ খাবার কিনতে হিমশিম খায়। আগস্ট মাসের তথ্য বলছে, ঐ মাসের খাবার কিনতে ঋণ নিয়েছেন ৬৪ শতাংশ মানুষ। টিসিবির পরিবেশকের দোকান বা ওএমএসের ট্রাক থেকে পণ্য কেনার জন্য সারিতে আজকাল নতুন নতুন মানুষ দেখা যাচ্ছে। পোশাক-পরিচ্ছদ বা চলনে-বলনে তাদের অনেকটা অসহায় মধ্যবিত্ত ধাঁচের মনে হচ্ছে। মধ্যবিত্তের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য নেই, নিম্নবিত্ত মহাসংকটে আর দরিদ্রের পেট ভরানোই দায় হয়ে পড়ছে। অথচ শিল্পবিপ্লবের ফলে গত ৩০০-৪০০ বছরে বৈষয়িক অর্জনে মানুষ যে সাফল্য অর্জন করেছে, মোগল আমলে তা ছিল কল্পনারও বাইরে। তবে কমবেশি খেয়ে-পরে প্রযুক্তিহীনভাবে বেঁচে থাকলেও সুখ-শান্তি উপচে পড়ার কথা ইতিহাস খুঁজলেই পাওয়া যায়। এই তো সেদিনকার কথা—বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান লিখেছেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। অভিধান সংকলক হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সোনার বাংলা’র অর্থ এভাবে করেছেন, ‘স্বর্ণপ্রসূ বঙ্গভূমি, সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বঙ্গভূমি’। অধিকাংশ ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন, ব্রিটিশ শাসনের আগে প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলার সব মানুষ ছিল সচ্ছল। সতেরো শতকে সুবা বাংলাকে ‘জান্নাত-আবাদ’ বা ‘স্বর্গরাজ্য’ বলে অভিহিত করা হতো। আবার এই অভিধা নাকি দ্বিতীয় মোগল সম্রাট হুমায়ুন নিজে দিয়েছেন। বাংলার অতুল ঐশ্বর্য এবং সব জিনিসপত্রের সুলভতার কথা কিংবদন্তিরূপে সমসাময়িক ইউরোপীয়দের বর্ণনায়ও পাওয়া যায়। তাদের অনেকের বর্ণনায়—‘এই রাজ্য ছিল সচ্ছল, ব্যয় বেশি নয়, এ দেশের মানুষ কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে সুখী। তারা প্রাচুর্য ও শান্তিতে জীবন যাপন করত।’ আর এখন অসহনীয় মূল্যস্ফীতি—দেশের বেশির ভাগ মানুষের সংসার চালানোর ব্যয় বেড়েছে, বিপরীতে আয় কমছে। ফলে রুজি-রোজগার যা হয়, তা বেঁচে থাকার ন্যূনতম প্রয়োজনীয় রসদ কিনতে না কিনতেই ফুরিয়ে যায়। তিল তিল করে যতটুকু সঞ্চয় জমেছিল তা ভেঙে খাওয়া শেষ বহু আগেই। এখন অনেকে পারিবারিক সম্পদ বিক্রি করে খাদ্য কিনছেন, আবার কেউ কেউ সহায়-সম্বল হারিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি অথবা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর মাসে ৩৭ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। আগস্টে এই সংখ্যা ছিল ৪৩ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে আয় বেড়েছে মাত্র ৯ শতাংশ মানুষের। অন্যদিকে ব্যয় বেড়েছে ৮৮ শতাংশ মানুষের। চতুর্দশ শতাব্দীতে বাংলায় ভ্রমণকারী বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা লিখেছেন, ‘আমার দেখা পৃথিবীতে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে জিনিসপত্রের দাম বাংলার চেয়ে সস্তা।’ সমসাময়িক চীনা পরিব্রাজক ওয়ান তু ওয়ানের বর্ণনায়ও বাংলায় দ্রব্যমূল্য সস্তার কথা পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এ ধরনের প্রাচুর্য ঐ আমলে সব সময়ই বিরাজ করত। তবে কি ব্রিটিশ-পূর্ব বাংলায় কখনো দুর্ভিক্ষ ঘটেনি? ইতিহাস ঘাটলে প্রাক-ব্রিটিশ বাংলায় অন্তত চারটি দুর্ভিক্ষের নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। ২ হাজার বছরে মাত্র চারটি দুর্ভিক্ষ এ কথাই প্রমাণ করে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলায় কম দুর্ভিক্ষ হয়েছে। যেখানে ১৯৩০-এর আগে চীনে গড়ে প্রতি বছর কমপক্ষে একটি করে দুর্ভিক্ষ দেখা দিত। তদুপরি বাংলাদেশে একসঙ্গে সর্বত্র খাদ্যাভাব খুব কমই দেখা গেছে এবং দুর্ভিক্ষের ব্যাপকতাও অন্যান্য দেশের তুলনায় ছিল কম। মূলত বাংলার ললাটে দুর্দশা নেমে আসে ব্রিটিশ শাসনামলে। এর প্রকটতা পাকিস্তান সৃষ্টির পর আরো বৃদ্ধি পায়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ পাচার শুরু হয়। ১৯৪৯-৫০ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ৩১০ রুপি থেকে ১৯৬৯-৭০ অর্থবছরে মাত্র চার রুপি বৃদ্ধি পেয়ে ৩১৪ রুপি হয়। পুরো পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল স্থবির, যা স্বাধীনতা-উত্তর ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। মাথাপিছু আয় কমে দাঁড়ায় মাত্র ৭৮ ডলার এবং ৮৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যায়। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ্বে এত গরিব পৃথিবীর কম দেশেই ছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ গড়ার নতুন প্রত্যয় নিয়ে বাঙালি ঘুরে দাঁড়ায়। শত শত মিল-কারখানা, ছোট-বড়, মাঝারি ব্যবসায়ী ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান এখন আমাদের নজর কাড়ে। ফলে জিডিপি আজ তরতর করে এগিয়ে চলেছে। আমাদের এই যে ধারাবাহিক উন্নয়ন, এর একমাত্র পন্থা হচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতি। আমরা বিশ্বায়নের উদারীকরণের অংশীদার। এ আজ নতুন এক বাংলাদেশ। বিদেশিদের কাছে নাকি এটি এক অচেনা বাংলাদেশ। জাতিসংঘের মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রাথমিক সূচকে আমাদের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার যে কোনো দেশ থেকে ভালো। দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে দেশে দারিদ্র্যের হার। করোনার আগে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ছিল ২১.৮ শতাংশ। বলা হয়ে থাকে, সবারই আয় বেড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের মধ্যে ৩৯তম এবং ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) ২৯তম, যা দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়। বাংলাদেশের জিডিপির আকার এখন ৪৬৫ বিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু জাতীয় আয় ২ হাজার ৮৬৪ ডলার। এটি নিঃসন্দেহে বিশাল সাফল্যের এক গল্প। তবে দেশের এই সফলতার সুফল কি সবাই সমানভাবে ভোগ করতে পারছে? দারিদ্র্যের কথা বিবেচনা করলে, করোনা-উত্তর সানেমের রিপোর্ট অনুযায়ী মহামারির কারণে দারিদ্র্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশে। দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকার এখন ভয়াবহ পর্যায়ে রয়েছে। শিক্ষিতদের মধ্যে ৩৩ শতাংশের বেশি বেকার। বিশেষ করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্তদের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশই বেকার। তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি, এক যুগ ধরে এই যে ধারাবাহিক ৬.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি—এটি ছিল কর্মসংস্থানহীন। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত ‘সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস স্প্রিং ২০১৮ : জবলেস গ্রোথ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রতিবছর কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। অথচ এই সময়ে প্রতি বছর গড়ে কর্মসংস্থানের হার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবমতে, ১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির বিপরীতে ভারতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় ৭ লাখ ৫০ হাজার, পাকিস্তানে ২ লাখ। আর বাংলাদেশে এই সংখ্যা মাত্র ১ লাখ ১০ হাজার। এই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, বছরে গড়ে সাড়ে ছয় লাখ করে কর্মসংস্থান হচ্ছে। অথচ বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি বছর ২০ থেকে ২২ লাখ কর্মক্ষম জনশক্তি শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে। ফলে দিনে দিনে দেশ একটি উচ্চ বেকারত্বের দেশে পরিণত হচ্ছে।
বেকারত্ব শুধু অর্থনৈতিক অভিশাপই নয়। বেকারত্ব একই সঙ্গে একটি মানবিক ও সামাজিক দুর্যোগও বটে। বেকারত্বের হার বাড়তে থাকলে সমাজের সুখ কমতে থাকে। জাতিসংঘের ‘বৈশ্বিক আবেগ প্রতিবেদন-২০২২’ শিরোনামের সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্বের অসুখী দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের স্থান সপ্তম, যা আমাদের সোনালি অতীত আর উন্নয়ন সফলতার গল্পকে অতিনাটকীয় করে তোলে।