বাংলাদেশের শিক্ষানীতির ঘন ঘন পরিবর্তন ধ্বংস করে দিতে পারে লাখো শিক্ষার্থীর জীবনের সঠিক লক্ষ্য এবং শেখার মনোজগৎ। এই পরিবর্তনকে একরকম শিক্ষাবৈষম্যও বলা যেতে পারে। মানুষের নিখাদ আস্থা যেটুকু এখনো শিক্ষার প্রতি রয়েছে, এই বিশ্বাস ভেঙে পড়ার কারণ হতে পারে এই পরিবর্তন। লাখ লাখ শিক্ষার্থী মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে শিক্ষা ও শেখার জগৎ থেকে। দুঃখের বিষয়, পরিবর্তনযোগ্য জায়গাগুলো রয়েছে অপরিবর্তিত। পরিবর্তন যেখানে প্রয়োজন, সেখানে রয়েছে সনাতন পদ্ধতি।
টেনেটুনে ধার করা শিক্ষানীতি কখনোই সুশিক্ষার আধার হতে পারে না, জাতির ধারক হতে পারে না। শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সুশিক্ষিত হওয়া। আর সুশিক্ষিত হওয়ার জন্য চাই আদর্শ শিক্ষক। একজন আদর্শ শিক্ষকের পাঠদানের কৌশল, বুদ্ধিদীপ্ত ও আকর্ষণীয় উপস্থাপন শিক্ষার্থীদের শেখার মনোজগেক আন্দোলিত করে। জ্ঞানের পিতা বিখ্যাত দার্শনিক ও শিক্ষক সক্রেটিস থেকে প্লেটো, অ্যারিস্টটল ও দ্রোণাচার্য্যের কথা কারো অজ্ঞাত নয়। আমি বিশ্বাস করি, কাগজে লেখা অক্ষরের চেয়ে একজন শিক্ষকের শেখানোর কৌশল অধিক কার্যকর। তাই আগে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষক বাছাইয়ে।
উন্নত বিশ্বের আঙ্গিকে শিক্ষানীতি ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করলেই উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত হয়ে যায় না। উন্নত ফলাফল ভোগের জন্য প্রয়োজন উন্নত ব্যবস্থাপনা এবং উন্নত কারিগর। তাই সবকিছু থাকা সত্ত্বেও যদি শিক্ষক নামের কারিগর, জাতির চালক যদি দুর্বল হয়, তাহলে নিষ্ফল সেই আয়োজন। একজন শিক্ষার্থী ও লেখক হিসেবে আমি মনে করি, পরিবর্তন প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যা, পাঠদানের কৌশল ও শিক্ষা বিরতির বিষয়ে। যদি একটি প্রতিষ্ঠানের অর্ধেক শিক্ষার্থীর বছরে টানা ছয় মাস দীর্ঘ বিরতির ব্যবস্থা করা হয় এবং এই সময়ে শিক্ষার্থীদের নিজেদের জীবিকা নির্বাহের জন্য কর্মমুখী শিক্ষালাভের সুযোগ দেওয়া হয়। বিষয়টি আরো চমৎকার হবে যদি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অধীনে সরকারিভাবে জীবনমুখী কাজ শেখানো হয়। ফলে কখনোই কোনো সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য কোনো বাবা-মাকে অতিরিক্ত বেগ পেতে হবে না, নিঃস্ব হতে হবে না। একজন শিক্ষার্থীকেও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের লক্ষ্যে ছুটতে হবে না, করতে হবে না বাবার অর্থের ওপর নির্ভরশীল। বরং কর্মক্ষম জনশক্তি বাড়বে। শুধু তাই নয়, বাড়বে দেশের জিএনপি এবং হ্রাস পাবে বেকারত্বের হার।
তাত্ত্বিকভাবে মানুষের গড় আয়ু কিছুটা বেড়ে গেলেও বাস্তবিক পক্ষে তার উলটোটি পরিলক্ষিত হয়। বর্তমান সময়ে মানুষের কর্মক্ষম আয়ুষ্কালও কমে গেছে বহুলাংশে। পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যা ও বৈচিত্র্য শিক্ষার্থীদের মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যদি আমি নিজেকে একজন ১০ বছরের শিশু হিসেবে কল্পনা করি, তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠ্যবিষয় হিসেবে বাংলা, গণিত ও ইংরেজি এই তিন মৌলিক বিষয়ই যথেষ্ট হিসেবে মনে করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ১০-১২ বছরের একটি শিশুকে গলাধঃকরণ করতে হয় উপর্যুক্ত তিনটি বিষয়সহ বিজ্ঞান, সমাজ, চারুকলাসহ মোট ছয়টি বিষয়। একটি শহর দিয়ে যেমন সমগ্র দেশের পরিমাপ করা সর্বদা সঠিক নয়, ঠিক তেমনি শহরে বেড়ে ওঠা তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত গৃহবন্দি শিক্ষার্থীদের গলাধঃকরণের সক্ষমতা দিয়ে সমগ্র শিশু শিক্ষার্থীদের তুলনা করা সঠিক নয়। গ্রামবাংলার শিশু-কিশোরদের কাছে ইংরেজি ও গণিতের যে সিলেবাসটি দেওয়া হয়, তা একটি শিশুর জন্য মোটেও আনন্দকর নয়, বরং সাংঘাতিক ব্যাপার। একটি ১০ বছরের শিশু, যে কিনা পাখির বাসায় ঢিল ছোড়ে, পাখির খোঁজে বনে-বাদাড়ে ঘুরে পাখি ধরতে ভালোবাসে, খোলা মাঠে খেলতে ভালোবাসে, গল্প শুনতে ভালোবসে, মাটির পুতুল ভালোবাসে, পুকুরে ঝাঁপ দিতে ভালোবাসে, চাঁদনি রাতে ভূতুড়ে গল্প শুনতে ভালোবাসে, সেই শিশুকে যখন বলা হয় একটি ইংরেজি বাক্য লিখতে, ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করতে, সমাজের সংজ্ঞা দিতে, পরিবেশের সংজ্ঞা দিতে, রবীন্দ্রনাথের জন্মতারিখ জানতে, নিউটনের বাড়ির ঠিকানা বলতে, তখন বিষয়টি কতটা যৌক্তিক, তা একজন বিশেষজ্ঞকে শিশু হয়ে কল্পনা করা উচিত। চলমান এই বিষয়টি শিশুটির মনোজগতে জন্ম দেয় ভয়, অপারগতা, লজ্জা, অনীহা। শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার বড় দুটি কারণ আর্থিক দীনতা এবং শিক্ষার প্রতি ভয়।
তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজি ও গণিত বইগুলোতে যে পরিমাণ পাঠ্যবস্তু দেওয়া আছে, তা অন্তত একটি গ্রামীণ বাচ্চার জন্য বড়সড় বোঝাই। ইংরেজি পরীক্ষায় যদি কোনো শিক্ষার্থী পরিপূর্ণ উত্তর করতে চায়, তবে সেই শিশুকে জানতে হবে ক্রিয়া, কাল, কর্ম, বাক্য, বাক্যের গঠন, শব্দের অর্থ, শব্দভান্ডার ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেও অনেক শিক্ষার্থী পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজি পরীক্ষার প্রশ্নের সঠিক উত্তর করতে পারে না। আর গণিত বইয়ের কথা না বললেই নয়—দেশীয় বিশেষজ্ঞরা বইটিতে এত বেশি সমস্যা, সমাধান ও অহেতুক চিত্র অন্তর্ভুক্ত করেছেন যে, মূল শিক্ষণীয় বস্তুটিই খুঁজে বের করা মুশকিল হয়ে যায়। দেশীয় শিক্ষাবিদগণ নিজেদের পাণ্ডিত্য দেখাতে গিয়ে একেকটা বইকে সহজ করতে গিয়ে অতিরঞ্জিত করে ফেলেন। ফলে মূল শিক্ষণীয় বিষয়টি ভয়ংকর হয়ে দাঁড়ায় এবং শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবস্তুবিমুখ করে ফেলে। তাই শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন যদি করতেই হয়, তবে আমাদের ভৌগোলিক অবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা, আমাদের বাচ্চাদের ধারণক্ষমতা, স্বাচ্ছন্দ্য, নিরপেক্ষতা বজায় রেখেই পরিবর্তন করা প্রয়োজন। তবে নতুন পরিবর্তন যেন চলমান শিক্ষাক্রম থেকেও পিছিয়ে না যায়, সেদিকে প্রথম নজর দেওয়া উচিত। সর্বোপরি আমাদের সমগ্র অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করেই পাঠ্যক্রম পরিবর্তন করা উচিত। পরিবর্তিত শিক্ষাক্রম যেন শিক্ষার্থীদের কষ্টের কারণ না হয়ে যায়।