বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জটিল সমস্যা হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। কোনো দেশই দাবি করতে পারবে না যে, তারা সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হচ্ছেন। বাংলাদেশেও বর্তমানে মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। সরকার নানাভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য চেষ্টা করছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক কোনো অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে না। ফলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিতে যাচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা না গেলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তথা গোটা অর্থনীতির জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ ভোক্তাশ্রেণি এতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
মূল্যস্ফীতি এমন একটি জিনিস, যা অর্থনীতির অসুস্থতার উপসর্গ এবং এর ক্ষতিকর প্রভাবক ক্ষমতা ব্যাপক। অর্থনীতির জন্য টেকসই উন্নয়নের অনুঘটক, যারা বিনিয়োগ, উৎপাদন ও সরবরাহের (বিপণন) কাজ করে থাকে তাদের জন্য মূল্যস্ফীতি যেমন সমস্যা সৃষ্টি করে, তেমনি ভোক্তাশ্রেণির মধ্যে চাহিদা সৃষ্টিও সীমিত হয়ে যায়। যারা বিত্তবান এবং চেষ্টা করলে আয় বাড়াতে পারেন, তারা মূল্যস্ফীতির কারণে তুলনামূলক কম ক্ষতিগ্রস্ত হন। কিন্তু যারা দরিদ্র ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ, তারা চাইলেই আয় বাড়াতে পারেন না। তারা মূল্যস্ফীতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে অর্থনীতি, রাজনীতিসহ অনেক কিছুরই উত্থান-পতনে পরস্পর সম্পৃক্ততা রয়েছে। কাজেই যে কোনো দেশের সরকারের প্রথম কাজ হচ্ছে অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির বিরূপ প্রভাবকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে আনা বা সীমিত রাখা। করোনা-উত্তর বিশ্ব অর্থনীতি যখন উত্তরণের পথে ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় দেশগুলোতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ইউক্রেনের খাদ্যপণ্য রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়। একই সঙ্গে রাশিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের জোগান কমিয়ে দেয়। ফলে বিশ্বব্যাপী পরিবহনের সংকট সৃষ্টি হয়, যা সর্বত্রই মূল্যস্ফীতিকে ঊর্ধ্বমুখী করে। বাংলাদেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতির পেছনে অভ্যন্তরীণ কারণ যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী হচ্ছে আন্তর্জাতিক কারণ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্থানীয় বাজারে পণ্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশ যেহেতু একটি আমদানিনির্ভর দেশ, তাই আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব অভ্যন্তরীণ বাজারেও পড়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছেন, সেখানেও এই মুহূর্তে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরাই হচ্ছে নতুন মুদ্রানীতির মূল উদ্দেশ্য। সবাই উপলব্ধি করেছেন, এই মুহূর্তে উচ্চ মূল্যস্ফীতিই দেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও বাংলাদেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে আমরা কীভাবে দেখছি বা কীভাবে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছি? উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমরা কী কী ব্যবস্থা নিতে পারি তা নিয়েই সর্বজনীন ও অনুপুঙ্খ হোমওয়ার্ক করা দরকার। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের আয়-ব্যয় বণ্টন বৈষম্য নিয়ে গিনিসহগের সূচকে দেখা যাচ্ছে, বিত্তবান ও বিত্তহীন মানুষের মধ্যে বিরাজমান অর্থনৈতিক বৈষম্য উদ্বেগজনক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য বৃদ্ধিতে দুর্নীতির ভূমিকা বা লক্ষণ আরো প্রতিভাত হচ্ছে, ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ছে না। সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে, যাদের প্রচুর টাকা আছে। অবৈধভাবে উপার্জিত সেই টাকার ওপর তারা কোনো ট্যাক্স প্রদান করেন না। অনেকেই তাদের উপার্জিত অর্থ এখানে প্রকাশ করেন না, বিনিয়োগ করেন না, বরং দেশের বাইরে পাচার করে দিচ্ছেন। এতে দেশ ও দেশের অর্থনীতি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অবৈধ অর্থের মালিকেরা সিন্ডিকেট হিসেবে এমন সব কাজ করেন, যাতে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পায়। এদের কারণে দেশের মানুষের নৈতিকতার ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এতে মনিটরিং বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আবার এটাও ঠিক, বাংলাদেশে বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কারো কাছে আলাদিনের চেরাগ নেই যে ইচ্ছে করলেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে ফেলতে পারবে। মূল্যস্ফীতি বিভিন্ন অসুখের কারণে সৃষ্টি হয়। ঝাড়ফুঁক দিয়ে এটা সমাধান বা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা কারণ এর পেছনে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে থাকে।
মূল্যস্ফীতির প্রধান অনুঘটক বৈষম্য সৃষ্টিকারীরা সমাজে অত্যন্ত প্রভাবশালী। সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গেলে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টিকারীরাই প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টিকারীরা কখনোই চায় না তাদের প্রভাব কমে আসুক। ব্যবসা-বাণিজ্য বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সিন্ডিকেটের হাতে চলে যায়। তারা ইচ্ছামতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের ভার যদি সবার হাতে থাকত, তাহলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই সহজ হতো। কোনো কোনো ব্যাবসায়িক গোষ্ঠী এখান থেকে ব্যাংকের ঋণ নিয়ে অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করে সেই টাকা দিয়ে মালামাল আমদানি করছে। এরা বাজারকে প্রভাবিত করার সুযোগ পাচ্ছে। যারা বৈধ ব্যবসায়ী তারা নানা ধরনের কর পরিশোধ করায় তাদের আমদানি করা পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাজারে তারা বেশি মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু যারা অবৈধভাবে পণ্য আমদানি করছেন, তাদের কোনো কর দিতে হচ্ছে না। তারা সংশ্লিষ্ট পণ্যটি বৈধ আমদানিকারকেরা যে মূল্যে বিক্রি করছেন, সেই মূল্যেই বিক্রি করছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার সময় আমদানির সময় সংশ্লিষ্ট পণ্যের অতিমূল্যায়ন ও রপ্তানির সময় কম (অন্ডার ইনভয়েস) মূল্য দেখাচ্ছে। এভাবে তারা আমদানির নামে বিদেশে অর্থ পাঠিয়ে রপ্তানির সময় বিদেশেই রেখে দিচ্ছেন।
রাজস্ব প্রদান ও মূল্যস্ফীতির মধ্যে প্রচণ্ড রকম সম্পর্ক আছে। রাজস্ব আদায়ের চারটি উদ্দেশ্য থাকে। একে বলা হয় ‘ফোর আর’। এগুলো হচ্ছে—(ক) রেভিনিউ, (খ) রিপ্রাইসিং, (গ) রিপ্রেজেনটেশন এবং (ঘ) রিডিস্ট্রিবিউশন। রিপ্রাইসিং অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কোন পণ্যের ওপর রাজস্ব আরোপ করা হবে, কোনটায় রাজস্ব আদায় ছাড় দেওয়া হবে। কোন পণ্যের ওপর রাজস্ব কমানো বা বাড়ানো হবে—বিষয়টি পণ্যমূল্যের ওপর ব্যাপক ভূমিক পালন করে থাকে। কাজেই রাজস্ব আয়ের সঙ্গে বাজারে দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। রি-ডিস্ট্রিবিউশন পণ্যমূল্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে থাকে। কর ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে কারো হাতে যেন সম্পদ কুক্ষিগত হওয়ার সুযোগ না পায়। সম্পদ কুক্ষিগত হলে সে চাহিদা ও সরবরাহ প্রক্রিয়ায় ডিসটরশন সৃষ্টির অপশক্তির ভূমিকায় চলে যায়। সরকার রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ট্যাক্সের মাধ্যমে যে অর্থ আদায় হয়, তা দিয়ে সরকার জনগণের জন্য বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে। যদি ট্যাক্স আদায় সঠিকভাবে না হয়, তাহলে সরকারকে তার প্রয়োজনীয় অর্থের জন্য দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। ঋণ না নিলে উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে অর্থ বণ্টনের ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়।
পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে রাজস্বব্যবস্থা। রাজস্ব আহরণের ব্যবস্থা স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হলে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়ে। সরকারকে তার উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাইরের কারো কাছে হাত পাততে হয় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আহরণের জন্য জনগণের ওপর ট্যাক্স বাড়াতে হয়। আমাদের সমাজে দেখা যাচ্ছে, একশ্রেণির উৎপাদন ও আমদানিকারক যথাযথভাবে ট্যাক্স না দিয়ে সরকারকে বঞ্চিত করছেন। একই সঙ্গে নিজে নিজে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন। রাষ্ট্র তার প্রাপ্য ট্যাক্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তারা একচেটিয়া ব্যবসা করছে। যখন-তখন জিনিসপত্রের মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরকার চেষ্টা করলেও এই অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী থাকলে অর্থনীতিতে নানা ধরনের অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। মূল্যস্ফীতি সব ভোক্তাশ্রেণিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। তবে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ে দরিদ্র শ্রেণির এবং নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ। কারণ তারা ইচ্ছে করলেই তাদের আয় বাড়াতে পারেন না।