ইউক্রেনকে ট্যাংক সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। এই ঘোষণা চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। এ নিয়ে বিশ্বরাজনীতির মঞ্চ স্বভাবতই বেশ সরগরম! যুদ্ধকবলিত ইউক্রেনকে সমর্থনের অংশ হিসেবে পশ্চিমারা ট্যাংক পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে—এর অর্থ এই নয় যে, ইউক্রেন যুদ্ধ রাতারাতি শেষ হয়ে যাবে। যদিও কোনো কোনো রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষক মনে করছেন তেমনটাই। যুদ্ধ এখন প্রায় শেষ—এই ধারণা অমূলক তো বটেই, বরং চলমান যুদ্ধ এখনো কয়েক মাস স্থায়ী হবে বলে ধরে নেওয়াই অধিক যুক্তিযুক্ত। বছরব্যাপী স্থায়ী না হলেও সহসাই বন্ধ হচ্ছে না রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত। তবে ইউক্রেনীয় বাহিনীর হাতে অস্ত্রশস্ত্র তুলে দেওয়ার যে ঘোষণা এসেছে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে, তা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও দেশটির জনগণের জন্য নিঃসন্দেহে স্বস্তির সংবাদ। চলমান যুদ্ধে এ এক বিশেষ মুহূর্তও!
ইউক্রেনকে যুদ্ধট্যাংক সরবরাহের ঘোষণা বেশ কিছু কারণে বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। উদাহরণস্বরূপ—যে ধরনের ট্যাংক সরবরাহের কথা বলা হয়েছে, তা ইউক্রেনকে বিশেষ সামরিক সুবিধা এনে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক অ্যাড আর্নল্ডের কথা অনুযায়ী, শক্তিশালী ট্যাংকগুলো যুদ্ধে পার্থক্য গড়ে দেবে—এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। ইউক্রেনের সেনাদের যে তিন ধরনের পশ্চিমা ট্যাংক সরবরাহের কথা বলা হয়েছে, তা রাশিয়ান বাহিনীকে যারপরনাই বেকায়দায় ফেলে দেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এম-১ আব্রামস, জার্মানির লেপার্ড-২ ও যুক্তরাজ্যের চ্যালেঞ্জার২—প্রতিটি ট্যাংকই সোভিয়েত যুগের টি-৭২-এর তুলনায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় শক্তিশালী। রুশ সেনাদের চরম ধরাশায়ী করতে এসব ক্ষিপ্রগতির ট্যাংকের জুড়ি মেলা ভার! এর সঙ্গে যদি ফরাসি লেক্লারক ট্যাংক যুক্ত হয়, তাহলে তো কথাই নেই—পুতিন বাহিনী নাস্তানাবুদ হয়ে পড়বে অতি অল্প সময়ে!
উল্লেখ করতে হয়, পশ্চিমা বিশ্বের ট্যাংকগুলো বহু দূরের লক্ষ্যবস্তুতেও নির্ভুলভাবে আঘাত হানতে সক্ষম। ব্যাপক গতিশীল ও প্রাণঘাতী ট্যাংকগুলো বাস্তবিক অর্থেই অগ্নিশক্তির মতো! ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ান বাহিনীকে এখন পর্যন্ত যে ধরনের অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা গেছে, তার সঙ্গে তুলনা করলে বলতে হয়, এই ট্যাংকগুলোর আক্রমণের মুখে রাশিয়ান ট্যাংক এক মুহূর্তও টিকতে পারবে না!
এখানে একটি বিষয় বলে রাখা দরকার, পশ্চিমাদের ট্যাংকগুলো তুলনামূলক ভারী। অর্থাত জলাবদ্ধ পরিবেশে এগুলো মাটিতে কিছুটা দেবে যেতে পারে। বিপরীতে, রাশিয়ান ট্যাংকগুলো কিছুটা হালকা হওয়ায় জলাবদ্ধ মাটিতে পুঁতে যাওয়ার ভয় নেই। এই একটিমাত্র সুবিধার দিক থেকে এগিয়ে থাকবেন রুশ সেনারা। কিন্তু তা সত্ত্বেও পশ্চিমা বিশ্বের আধুনিক মানের ট্যাংকগুলো এতাটাই নির্ভুল নিশানা করতে সক্ষম যে, এর আক্রমণ রুখতে পারা শুধু কঠিনই নয়, অনেকটা অসম্ভবই! ট্যাংকগুলোর নেভিগেশন সিস্টেম এতটাই অত্যাধুনিক যে, কি রাত কি দিন—সব সময়ই বাড়তি সুবিধা এনে দেবে ইউক্রেনের আর্টিলারি ও পদাতিক বাহিনীকে। উপরন্তু আক্রমণ রুখে দিয়ে পালটা আক্রমণ করার ক্ষেত্রে ট্যাংকগুলোর রয়েছে বিশেষ পারঙ্গমতা। মোট কথা, সম্মিলিত কৌশল বাস্তবায়নে ইউক্রেনের সেনাদের সর্বাত্মক সক্ষমতা এনে দেবে ট্যাংকগুলো, যা যুদ্ধের ময়দানে রাশিয়ান সেনাদের নিশ্চিতভাবে ফেলে দেবে বেশ বেকায়দায়।
বলা হচ্ছে, পশ্চিমা ট্যাংক হাতে পেয়ে এর সুবিধাকে ঠিকঠাকভাবে কাজে লাগাতে পারলে রাশিয়ান অধিকৃত ইউক্রেনীয় অঞ্চলগুলো স্বল্প সময়ে উদ্ধার করতে সক্ষম হবে ইউক্রেনের সেনারা। এর ফলে রাশিয়ার যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাম্রাজ্য বিস্তারের অভিপ্রায়কে থামানো সহজতর হবে। মোটা দাগে উল্লেখ করার মতো বিষয়, মিত্রদের কাছ থেকে ইউক্রেন যদি প্রতিশ্রুত অস্ত্রসহায়তা পায়—অবশ্যই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব—তাহলে শেষ পর্যন্ত জয়ের পাল্লা হেলে থাকবে ইউক্রেনের দিকে। এর ফলে কিয়েভ মস্কোকে ইচ্ছেমতো দৌড় করাতে পারবে—হোক যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে বাধ্য করে কিংবা ‘শান্তি’র প্রশ্নে পছন্দমতো শর্ত মানাতে বাধ্য করে। যদিও এর জন্য বেশ ঘাম ঝরাতে হবে ইউক্রেনকেও।
ভুলে গেলে চলবে না, পশ্চিমারা ট্যাংক পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে বটে, কিন্তু এখনো ঝুলে আছে দুটি বিষয়—সংখ্যা এবং রসদ তথা প্রশিক্ষণ। ইউক্রেন বারংবার দাবি করছে, ৩০০-র মতো ট্যাংক হাতে পেলে রাশিয়ান বাহিনীকে গুঁড়িয়ে দেবে ইউক্রেনের সেনারা। কিন্তু বার্লিন ও অন্যদের ঘোষণা অনুযায়ী, ১০০-র বেশি ট্যাংক পাচ্ছে না ইউক্রেন। এক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকেই যায়, চাহিদামতো অস্ত্র না পেলে ইউক্রেন কি প্রত্যাশানুযায়ী ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? বিশ্লেষকরা যেমনটি বলছেন—ইউক্রেন যুদ্ধ দেখিয়েছে, আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে কত বিশাল পরিমাণে ট্যাংক প্রয়োজন। যার হাতে শক্তিশালী ও অত্যাধুনিক ট্যাংক থাকবে, দিন শেষে বিজয়ের মুকুট যাবে তার ঘরেই।
জটিলতা আছে আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে। যেমন—দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস মার্কিন কর্মকর্তাদের সতর্ক করে বলেছে, মার্কিন ট্যাংকগুলো মোতায়েনের জন্য দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে! জার্মানির লেপার্ডসহ আরও কিছু দেশের ট্যাংকগুলোও মাঠে নামাতে সময় লাগবে বেশ খানিকটা। অর্থাৎ যথাসময়ে ইউক্রেন অস্ত্র পাবে কি না—এই প্রশ্ন থেকেই যায়। এর সঙ্গে আরেকটি গুরুতর জটিলতা হলো, যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে না পারলে ট্যাংক হাতে পেয়েও তা কাজে লাগানো যাবে না কাঙ্ক্ষিত মাত্রায়। এসব কিছুকে ছাপিয়ে বড় জটিলতা হলো, ট্যাংক সরবরাহের বিষয়ে জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এখন পর্যন্ত তাকে সীমিতই বলা যায়। ওয়াশিংটনের দিক থেকেও চিত্র একই। সত্যি বলতে, ইউক্রেন যে সংখ্যক ও মানের অস্ত্রসহায়তা চাইছে, তা যদি সরবরাহ করা না যায় তথা ‘হাতে রেখে দেওয়া’ সহায়তা কোনো কাজে আসবে না ইউক্রেনের। এবং সময় থাকতে তা হাতে না পেলেও কাজের কাজ কিছুই হবে না। তবে ইউক্রেনের জন্য আশার খবর হলো, অস্ত্রসহায়তা বাড়ানো হবে বলেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
জেনে রাখা দরকার, ইউক্রেনকে অস্ত্রসহায়তার প্রশ্নে প্রায় প্রতিটি দেশের সরকারকেই অভ্যন্তরীণ নানা হিসাবনিকাশ মাথায় রাখতে হচ্ছে। জার্মানির মতো দ্বিধান্বিত অনেক রাষ্ট্রই। এর পেছনে যুক্তিযুক্ত কারণ আছে বইকি! মূলত নিজ দেশের ভেতরের নানা সমীকরণকে আমলে নেওয়ার পাশাপাশি দেশগুলোর সরকার তাকিয়ে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। আমেরিকার সঙ্গে পা মিলিয়ে চলছে প্রায় সবগুলো দেশ—সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এসবের মধ্যেও আসল সত্য হলো, ইউক্রেনকে রক্ষা করাই দেশগুলোর মূল লক্ষ্য। আর সত্যি বলতে, রাশিয়াকে থামনোটাও পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য ‘অতি জরুরি’। কেননা ইউরোপের জন্য ক্রমাগতভাবে হুমকি হয়ে ওঠা পুতিনকে থামাতে না পারলে কিংবা পুতিন খুব সহজেই ইউক্রেনকে কবজা করে ফেললে তা হবে গোটা ইউরোপের জন্য ‘অশনিসংকেত’!
যাহোক, ইউক্রেনকে পশ্চিমের অস্ত্র সরবরাহের ঘোষণার অর্থ হলো, এই যুদ্ধে পশ্চিমারা আরও বেশি জড়িয়ে গেল! স্পষ্ট করে বললে, ইউক্রেনের স্বাধীনতা রক্ষার প্রশ্নে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি অস্ত্র হাতে তুলে নিল পশ্চিমারা। অনেকেই বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ এখন আর রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের যুদ্ধ নয়, বরং এই যুদ্ধকে এখন বলা যায়, রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের যুদ্ধ! কিন্তু এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, পশ্চিমারা কোনোভাবেই চায়নি এই যুদ্ধ। রাশিয়ার অযাচিত আগ্রাসন ঠেকাতে ও ইউরোপের অখণ্ডতা বজায় রাখতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাঠে নামতে বাধ্য হচ্ছে পশ্চিমারা। অনেকেই বলছেন, পশ্চিমাদের স্বার্থের পক্ষে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করছে ইউক্রেন—এই ধারণাও সঠিক নয়। এই বাস্তবতাকে না মেনে কোনো উপায় নেই, পশ্চিমাদের পদক্ষেপ সম্পূর্ণরূপে রক্ষণাত্মক। ইউক্রেনবাসীকে হানাদারদের হাত থেকে মুক্ত করতে সাহায্য করার বাইরে এখন পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে প্রমাণ করতে পারবেন না কেউ। ট্যাংক সরবরাহের ঘোষণার দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যায়, চাহিদামতো ট্যাংক পাচ্ছে না ইউক্রেন। একই সঙ্গে অন্য অস্ত্রশস্ত্র বারবার চেয়েও পাচ্ছেন না জেলেনস্কি। এরকমটা চলে আসছে যুদ্ধের শুরু থেকেই। সবার মনে থাকার কথা, যুদ্ধে কোণঠাসা হয়ে পড়ার পর পুতিন যখন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়ে যাচ্ছিলেন ক্রমাগতভাবে, তখনো ইউক্রেনের সঙ্গে অস্ত্র সরবরাহ নিয়ে দর কষাকষি করেছে পশ্চিমা বিশ্ব। এমনকি শুরু থেকেই অত্যাধুনিক ও ভারী পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র চেয়েও এখন অবধি তা পাননি জেলেনস্কি। কাজেই ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য দায়ী করে পশ্চিমা বিশ্বকে দোষারোপ করা মস্তবড় ভুল হবে। খেয়াল করলে দেখা যায়, লম্বা সময় ধরে চললেও থামনো যায়নি ইউক্রেন সংঘাত। কোনো কিছুতেই থামনো যাচ্ছে না একগুঁয়ে পুতিনকে। এই যখন অবস্থা, তখন ইউক্রেনের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়াকেই সঠিক বলে মনে করেছেন পশ্চিমা নেতারা। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার প্রতি পশ্চিমাদের কঠোর মনোভাব প্রকাশ তো পেলই; একই সঙ্গে এটাও স্পষ্ট হলো—যুদ্ধের মাঠে যতই আগ্রাসি হয়ে উঠবেন পুতিন, ততই আটকে যাবেন ‘পশ্চিমা বাধা’র মুখে। এটাই সত্য, এটাই বাস্তবতা।