গত বুধবার বেলা ১১টা। ‘রোড সেফটি কোয়ালিশন বাংলাদেশ’-এ কাজ করার সুবাদে নিরাপদ সড়ক ব্যবহার-সম্পর্কিত আলোচনার জন্য এক সংবাদকর্মীর সঙ্গে দেখা করতে রাজধানীর বনানীর উদ্দেশে ডিজিটাল মাধ্যমে রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে মোটরসাইকেল কল করে শ্যামলী শিশুমেলার সামনে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়িয়ে সামনের রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা দেখছি। কিছুক্ষণ পরে নজরে এলো একটি মোটরসাইকেল চালক হেলমেট ব্যবহার করলেও, যাত্রী তার ব্যবহৃত হেলমেটটি ব্যবহার না করে হাতে নিয়ে বসে যাত্রা করছেন। সামনে যেতেই ট্রাফিক তাদের থামালেন। তখনই ঘটল বিপত্তি। ট্রাফিক অফিসার মোটরসাইকেল চালককে তার পেছনের যাত্রী হেলমেট ব্যবহার না করার কারণ জানতেই চালক পেছনে ফিরে দেখলেন তার মোটরসাইকেল বসা যাত্রী হেলমেট ব্যবহার না করে হাতে নিয়ে বসে আছেন। চালক অবাক হয়ে গেলেন। ট্রাফিক অফিসারকে বললেন, ‘স্যার আমি রাইড শেয়ারিং করি। ১৫০ টাকার ভাড়া নিয়ে যাচ্ছি। আমার মোটরসাইকেলের যাত্রীকে হেলমেট ব্যবহারের জন্য মোটরসাইকেলে বসার আগেই তার মাথায় নিজেই হেলমেট পরিয়ে দিয়েছি। কিন্তু কখন যে তিনি হেলমেট মাথা থেকে খুলে হাতে নিয়ে বসে আছেন, আমি খেয়াল করিনি। আমাকে মামলা না দিয়ে এবারের মতো ছেড়ে দিন।’ কিন্তু ট্রাফিক অফিসার চালকের কথায় কর্ণপাত না করে হেলমেট ব্যবহার না করার কারণে ১ হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দিলেন। তখন মোটরসাইকেল চালক ঐ যাত্রীর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে গেলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, যে হেলমেটটি ব্যবহার না করার জন্য জরিমানা করা হলো, সেটি ভাঙাচুরা একটি নিম্নমানের হেলমেট ছিল।
পরে সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ করার জন্য ট্রাফিক অফিসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে জানতে চাইলাম, জরিমানাকৃত মোটরসাইকেল যাত্রীর ব্যবহারের জন্য যে হেলমেটটি ছিল সেটি মানসম্মত হেলমেট কি না, দুর্ঘটনা ঘটলে এই হেলমেটটি যাত্রীকে নিরাপদ রাখবে কি না। উত্তরে ট্রাফিক অফিসার বললেন, আমাদের দেশে হেলমেটের মান নির্ণয়ের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে সরকার খুব দ্রুত মোটরসাইকেলের হেলমেটের ক্ষেত্রে মান নির্ধারণ করে দেবে। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী মোটরসাইকেল চালক এবং যাত্রী উভয়ই হেলমেট ব্যবহার না করলে জরিমানা করার বিধান রয়েছে। তাই কোনো চালক বা যাত্রী হেলমেট ব্যবহার না করলে আমরা আইন অনুযায়ী তাদের জরিমানা করে থাকি।
সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী, মোটরসাইকেলে যাত্রী থাকলে চালকসহ দুই জনকেই হেলমেট পরতে হবে। এ নিয়ে কড়াকড়ি আরোপের পর মোটরবাইক রাইডারদের অতিরিক্ত হেলমেট বহন করতে দেখা যায়। তবে প্রশ্ন উঠেছে, হেলমেটের মান নিয়ে। দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে জীবন রক্ষার জন্য হেলমেট পরায় বাধ্যবাধকতা থাকলেও, তা দাঁড়িয়েছে ‘নিয়ম রক্ষার’। বিশেষ করে আরোহীর মাথায় যে হেলমেট, তাতে জীবনের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। আরোহীর মাথায় পরা হেলমেট হালকা এবং নিম্নমানের। এ ধরনের হেলমেট ব্যবহারে উদ্দেশ্য সাধন তো হচ্ছেই না বরং ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
একটা সময় মোটরসাইকেল আরোহীরা হেলমেট ব্যবহার করতেন না। তবে ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের ‘কারাদণ্ড’ ও ‘জরিমানা’ এড়াতে দুই-তিন বছর ধরে পালটে গেছে সেই চিত্র। চালক ও আরোহীদের অধিকাংশই এখন হেলমেট পরছেন; কিন্তু হেলমেট পরার হার বাড়লেও কমেনি দুর্ঘটনায় মৃত্যু।
গত বছরের ২৭ অক্টোবর সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা জোরদার এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠিত কমিটির ১১১ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য টাস্কফোর্সের সভা শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, মোটরসাইকেলের হেলমেটের মান নির্ধারণ করে দেবেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সে অনুযায়ী চালক ও আরোহীদের নির্ধারিত মানের হেলমেট ব্যবহার করতে হবে।
রাজধানীসহ সারা দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় একাধিক মৃত্যুর খবর আসছে প্রায় প্রতিদিন। এসব দুর্ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আরোহীর মাথায় হেলমেট থাকলেও তাদের জীবন রক্ষা হচ্ছে না। এর মূল কারণ হচ্ছে মানসম্মত হেলমেট নেই। আমরা হেলমেট পরছি কিন্তু সেটা নিম্নমানের হেলমেট। জীবন রক্ষা করার জন্য নয়, শুধু পুলিশের মামলা থেকে বাঁচতেই আমরা নামমাত্র হেলমেট ব্যবহার করে সড়কে নামছি, যা সড়ক দুর্ঘটনায় আমাদের মৃত্যুর ঝুঁকিতে রাখছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, বিদায়ি বছর ২০২২ সালে ৬ হাজার ৮২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৭১৩ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২ হাজার ৯৭৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩ হাজার ৯১ জন। নিহতের মধ্যে ৭৬ দশমিক ৪১ শতাংশ ১৪ থেকে ৪৫ বছর বয়সী।
বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের (এআরআই) সর্বশেষ গত ২০২১ সালের এক যৌথ গবেষণায় দেশে মোটরসাইকেল চালক ও যাত্রীদের হেলমেট ব্যবহারের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। গবেষণাপত্র থেকে জানা গেছে, দেশের সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ৮৮ শতাংশই মারা যাচ্ছেন হেলমেট না পরার কারণে। আর হেলমেট পরিহিত অবস্থায় মারা যাচ্ছেন ১২ শতাংশ চালক-আরোহী।
পরিশেষে বলা জরুরি, যে হারে মোটরসাইকেল সড়কে নামছে এবং দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে, এতে সরকারের দায়িত্বশীলদের সড়কে দুর্ঘটনারোধে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। হেলমেটের মান যাচাইয়ে সরকারি সংস্থাগুলোর উদ্যোগ নিতে হবে। মানহীন অনিরাপদ হেলমেট ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাজারে ভালো হেলেমেট নিশ্চিত করতে হবে। যাতে নিম্নমানের সস্তা হেলমেট বিক্রি না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। সব থেকে বড় বিষয় হচ্ছে, মোটরসাইকেল চালক ও যাত্রীরা সচেতন না হলে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু থেকে কোনোভাবেই রেহাই পাওয়া যাবে না। একটি ভালো হেলমেট কমাতে পারে দুর্ঘটনায় হতাহতের আশঙ্কা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যথাযথভাবে হেলমেট ব্যবহারে দুর্ঘটনা মৃত্যুঝুঁকি ৪০ শতাংশ কমে যায়। আর জখম থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায় ৭০ শতাংশ।