ডলারের সংকটে গত কয়েক মাস যাবত পণ্য আমদানিতে নেতিবাচক অবস্থা বিরাজ করছে। মাঝারি আমদানিকারকেরা পণ্য আমদানি থেকে ছিটকে পড়েছেন। ফলে ভোগ্যপণ্যের বাজার পুরোপুরি কয়েকটি করপোরেট হাউজের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। তাদের কাছে আগে আমদানি করা প্রচুর পণ্য রয়েছে। নতুন করে পণ্য আমদানির এলসিও করপোরেট হাউজগুলো করেছে। বন্দরের আউটারে ভোগ্যপণ্য নিয়ে প্রায় এক ডজন জাহাজ অপেক্ষা করছে। এসব জাহাজে চিনি, সয়াবিন, ছোলা ও মশুরের ডালসহ অন্যান্য পণ্য রয়েছে। কিন্তু পণ্য খালাসে চলছে ধীরগতি। এতে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা করা হচ্ছে বলে খাতুনগঞ্জের একাধিক পাইকারি বিক্রেতা অভিযোগ করেছেন। কারসাজি ঠেকাতে সরকারিভাবে বাজার মনিটরিং জরুরি বলে মনে করছেন অনেকেই।
দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার আমদানিনির্ভর। সামনে পবিত্র রমজান মাসে চাহিদা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। বর্তমানে পণ্য আমদানি করছে কয়েকটি করপোরেট হাউজ। খাতুনগঞ্জে মাঝারি পর্যায়ের আমদানিকারকেরা এলসি করতে না পেরে বসে পড়েছেন। অনেক আমদানিকারক ব্যবসায়ী রয়েছেন, তারা কয়েক জন মিলে একসঙ্গে এলসি করেন। কিন্তু এবার তারা পারেননি। তারা এখন করপোরেট হাউজের কাছে পণ্য নিতে ধরনা দিচ্ছেন। ফলে অত্যাবশ্যকীয় ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ে কারসাজি শুরু হয়েছে। এমনিতে পণ্যের দাম বাড়তি। আরো কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে আমদানিকারকেরা কারসাজিতে লিপ্ত হয়েছেন বলে বিক্রেতাদের অভিযোগ।
লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের সংগঠন ওয়াটার ট্রাসপোর্ট সেল সূত্র জানায়, বন্দরের আউটারে আমদানি করা ভোগ্যপণ্য নিয়ে অনেক জাহাজ নোঙর করে আছে। এসব জাহাজে চাল, গম, ছোলা, মশুর ডাল, চিনি, সয়াবিন, খেজুরসহ নানা পণ্য রয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে চলছে ধীরগতি। এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে গতকাল রবিবার খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সবচেয়ে বেশি চিনির দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। পাইকারি চিনি প্রতি মণ গতকাল বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৯৩০ টাকা। গত বৃহস্পতিবারের তুলনায় গতকাল চিনি প্রতি মণে প্রায় ১০০ টাকা বেড়েছে। বিক্রেতারা জানান, সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। বন্দরের আউটারে চিনি নিয়ে তিনটি জাহাজ খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে। আবার পাইপলাইনে রয়েছে। কিন্তু চিনির দাম বাড়ার কোনো কারণ মিলছে না। চট্টগ্রামে স্থানীয় একটি শিল্প গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে চিনির পাইকারি বাজার। এছাড়া ঢাকার কয়েকটি শিল্প গ্রুপও চিনি বিক্রি করে। চিনি বাজারজাত করার জন্য তাদের পছন্দের গুটি কয়েক ডিও ব্যবসায়ীকে পরিবেশক নিয়োগ করা হয়েছে।
রমজানের অন্যতম চাহিদাপূর্ণ ছোলার বাজারও অস্থির। পাইকারি প্রতি মণ ছোলা মানভেদে ২ হাজার ৮৫০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সেই হিসাবে প্রতি কেজির দাম পড়ছে প্রায় ৭৫ টাকা। বর্তমানে খুচরা বাজারে ছোলা কেজি ৯০ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে মশুর ডাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ ৩ হাজার টাকা।
জানতে চাইলে ডালজাতীয় পণ্য আমদানিকারক আশুতোষ মজুমদার বলেন, ‘আমি খুব অল্প পরিমাণে ছোলা আমদানি করেছি। ডলারের সংকটের কারণে এলসি করতে পারেনি। বড় গ্রুপগুলো বেশি পণ্য আমদানি করেছে।’ এছাড়া পাইকারিতে খোলা সয়াবিন প্রতিমণ ৬ হাজার ৪০০ টাকা আর পাম অয়েল প্রতি মণ ৪ হাজার ৬০০ টাকা। বিক্রেতারা জানান, সয়াবিনের দাম না বাড়লেও পাম অয়েলের দাম ঊর্ধ্বমুখী।
চাক্তাই খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শুনেছি, চিনি নিয়ে আউটারে তনিটি জাহাজ অপেক্ষা করছে। টাকা পরিশোধ নিয়ে জটিলতায় খালাস হচ্ছে না। এসব চিনি বাজারে এলে দাম কমতে পারে। ভোগ্যপণ্য বড় কোম্পানিগুলোর কাছে রয়েছে। মাঝারি আমদানিকারকদের কাছে পণ্য নেই। এখন পাইকারিতে বেচাকেনাও কম। গত বছর রমজানের আগে এই সময়ে বিভিন্ন স্থান থেকে খুচরা বিক্রেতারা এসে পণ্য নিয়ে গেছেন। এবার কিন্তু বেচাকেনায় মন্দা বিরাজ করছে।’
এ ব্যাপারে দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক আবুল বশর চৌধুরী বলেন, ‘এলসি খোলা নিয়ে নানামুখী জটিলতা হচ্ছে। নানা শর্ত দেওয়া হচ্ছে। যাচাইবাছাই করে এলসির অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। ১৮০ দিনের মধ্যে পণ্যের টাকা পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে পণ্য বিক্রি না হলে টাকা কীভাবে পরিশোধ করবে। আমি ইতিমধ্যে ৭ হাজার মেট্রিক টন ছোলা আমদানি করেছি। আরো ডালজাতীয় পণ্য আমদানির এলসি করেছি। আগামী এক মাসের মধ্যে এসব পণ্য চলে আসবে। ইতিমধ্যে অনেকেই ভোগ্যপণ্য আমদানি করেছেন। সামনে বাজারে কী অবস্থা বিরাজ করবে, তা বলা যাচ্ছে না। তবে পণ্যের কোনো ঘাটতি হবে না।’
এদিকে চট্টগ্রামে প্রায় ১ হাজার ২০০ বাণিজ্যিক পণ্য মজুতের গুদাম রয়েছে। এসব গুদামে জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের পর মজুত রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে বিক্রি হলে গুদাম থেকে ডেলিভারি দেওয়া হয়। জানা গেছে, বাণিজ্যিক গুদামগুলো অধিকাংশই খালি হয়ে পড়েছে। গুদামে পণ্য নেই। আমদানি কমে যাওয়ায় বাণিজ্যিক গুদাম ব্যবসায়ীরা লোকসান গুনছেন।
চট্টগ্রাম গুদাম মালিক সমিতির সভাপতি শফিক আহমেদ বলেন, ‘আমাদের অধিকাংশ গুদাম খালি। লোকসান দিতে হচ্ছে। কারণ আমাদের গুদামে মাঝারি ছোট ব্যবসায়ীরা পণ্য রাখেন। কিন্তু ডলারের সংকটে তারা পণ্য আমদানি করতে পারেননি। আর বড় আমদানিকারকদের নিজস্ব গুদাম রয়েছে। তারা সেখানে রাখেন।’